মত ও পথ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সংগঠন এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারীরা দলীয় মনোনয়ন লাভে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, বরং দলের উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলো ভোটারদের কাছে তুলে ধরতে হবে এবং তাদের বোঝাতে হবে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে ২০০১ সালের মতই কি ভয়াবহ ব্যাপার ঘটতে পারে। তিনি বলেন, ‘যিনি আমার দলের বিরুদ্ধে বদনাম করবেন সে কি এটা বোঝেন না, এতে তার ভোটও নষ্ট হবে।’ সে তাহলে কোনমুখে ভোট চাইতে যাবে, প্রশ্ন তোলেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশেষ বর্ধিত সভায় সভাপতির বক্তৃতায় একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী আগামীর জাতীয় নির্বাচনকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং আখ্যায়িত করে বলেন, ‘সামনে আমাদের নির্বাচন। সবসময় মনে রাখতে হবে, এটা আমাদের একটানা তৃতীয় নির্বাচন। আর নির্বাচন মানেই সেটা চ্যালেঞ্জিং হবে এবং এই নির্বাচনে সকলকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সময় কিন্তু আর বেশি নাই কেউ দলীয় মনোনয়ন পাবেন কি পাবেন না সেটা নির্ভর করে এলাকায় কতটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছেন আর দলের নেতা-কর্মীদের কিভাবে মূল্যায়ন করছেন তার ওপর।’
প্রধানমন্ত্রী দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি আপনাদের কাছে এটুকুই চাইবো আমরা যে কাজগুলো করেছি সেই কথাগুলো জনগণের কাছে আপনাদের পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের দলের পক্ষ থেকেই এই কথাগুলো মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে যে, আমরা আপনাদের জন্য এই কাজ করেছি এবং এই কাজগুলো আগামীতে করবো।
তিনি বলেন, ২০০৮ এর নির্বাচনের আগে আমরা যে ঘোষণা দিয়েছিলাম তার চেয়ে অনেক দূর আমরা এগিয়ে গিয়েছি। ২০১৪ এর নির্বাচনী ইশতেহার থেকেও আমরা এগিয়ে গিয়েছি। পরের বারে আমরা আরো অগ্রগতি করতে সক্ষম হব। কাজেই আওয়ামী লীগ যে কথা দেয়, সে কথা রাখে। সেকথাটাই মনে রাখতে হবে। আর জনগণকে সেকথা বলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দলের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টিকারীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি লক্ষ্য করেছি কেউ কেউ স্বপ্রণোদিত প্রার্থী হয়ে বিএনপি কি সন্ত্রাস করলো, লুটপাট, দুর্নীতি করলো, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করলো সেটা বলে না। অথচ তাদের বক্তব্য এসে যায় আওয়ামী লীগ এমপির বিরুদ্ধে, সংগঠনের বিরুদ্ধে।’
তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সকল কিছু বাদ দিয়ে কেবল দলের জন্য, দেশের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেন, উন্নয়নের কাজ করেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি একটা ঘোষণা দিতে চাই- কেউ যদি আমার দলের উন্নয়নের কথাগুলো না বলে কোথায় কার কি দোষ আছে সেগুলো খুঁজে বের করে জনগণের কাছে গিয়ে বলেন তারা আওয়ামী লীগের নমিনেশন পাবেন না। এটা পরিষ্কার।’
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদি কেউ ৫ বছর, ৫ বছর ১০ বছর সরকারে থাকার পর দলের বিরুদ্ধে বদনাম করে তাহলে জনগণতো তাকেও ভোট দেবে না। এটা হলো বাস্তবকথা কাজেই একথাটা সবাইকে মনে রাখতে হবে।
এটা ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং আজকাল সব কথাই রেকর্ড হয় এবং চাইলে মোবাইল মারফত সেগুলো তিনি শুনতেও পারেন বলেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় তাঁর মোবাইল ফোনে দিনে তিন-চারশো ক্ষুদে বার্তা আসে এবং সময় পেলেই তিনি প্রতিটি বার্তা পড়েন এবং সংশিষ্ট সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন বলেও তিনি জানান। প্রার্থী হবার অধিকার সকলের আছে কিন্তু প্রার্থী হতে গিয়ে দলের বদনাম করা তিনি সহ্য করবেন না বলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী এ সময় দলীয় সংসদ সদস্যদের দলের ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়নের আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যারা সংসদ সদস্য আছেন তাদেরকেও আমি বলবো একটা কথা মনে রাখবেন- জনগণ কিন্তু খুব হিসেবি কেউ দুর্নীতি করলে জনগণ কিন্তু সেটা ঠিকই মাথায় রাখবে। সেটা কিন্তু তারা ভুলে যায় না। কাজ করতে গিয়ে টাকা নিলে পরে ভোট চাইতে গেলে তারা বলবে টাকা দিয়ে কাজ নিয়েছি ভোট দেব কেন?’
প্রধানমন্ত্রী জনগণের সচেতনতার কথা উল্লেখ করে আরো বলেন, জনগণের এখন কিন্তু চক্ষু খুলে গেছে। এখন ডিজিটাল যুগ। তারা এখন বিশ্বকে জানতে পারছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু জেলে থাকাকালীন আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা-কর্মীদের সেটাকে ৮ দফায় নিয়ে যাবার প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে বলেন, আওয়ামী লীগের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে, আমার ছোট বেলা থেকেই দেখা তিনি (বঙ্গবন্ধু) জেলের ভেতরে থাকলে আওয়ামী লীগের কি চেহারা আর বাইরে থাকলে কি চেহারা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই দুঃসময়ে যারা মাঠে থাকে, দুঃসময়ে দলের ভার বয়ে যারা রাখে, সেই দুঃসময়ের কর্মীরা যেন অবহেলিত না হয়। সেটা মনে রাখতে হবে।
দল ক্ষমতায় থাকলে সুবিধাভোগী শ্রেনী অন্য দল থেকে দলে এসে ভিড়লেও অসময়ে তাদের পাওয়া যায় না উল্লেখ করে গ্রুপিং এর দল ভারি করার জন্য এদের দলে ভেড়ানো থেকে বিরত থাকার জন্যও তিনি নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান।
বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসি, নির্যাতনকারী, লুটপাটকারীরা মামলা থেকে বাঁচার ভয়ে অনেকেই আওয়ামী লীগে ভিড়তে চাইতে পারে উল্লেখ করে তাদের সম্পর্কেও দলের সকলকে সতর্ক থাকার জন্য নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
অতীতে এসব অনুপ্রবেশকারীদের দলের কেউ কেউ প্রশ্রয় দিয়ে থাকলেও এখন এদের বিদায় দেয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে অনেক দুরভিসন্ধি নিয়ে দলে আসে। কাজেই এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের যথেষ্ট সজাগ থাকতে হবে এবং নিবেদিত প্রাণ হয়ে জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করতে হবে।
আগামী নির্বাচন অতিব গুরুত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার হিসেব না মিলিয়ে দেশকে কি দিতে পারলাম বা আগামীতে কতটুকু কি দিতে পারবো তা মাথায় রেখেই ত্যাগের মনোভাব নিয়ে আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী করার জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়েও সকলকে কাজ করার আহবান জানান। প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির পিতার হত্যাকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দন্ড কার্যকর হবার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সাক্ষীদের নিরাপত্তা প্রদানে সচেষ্ট থাকার জন্যও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী এ দিন আগামীর নির্বাচনও জোটবদ্ধভাবে করার দিকেও ইঙ্গিত দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জোট করেছি মহাজোট করেছি। নির্বাচনের স্বার্থে জোট করতে হয়। আমরাও করবো, আমরা বন্ধু হারাব না। সবাইকে নিয়েই করতে চাই।’
তবে, এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দায়িত্বটা অনেক বেশী উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এদেশের সব থেকে বড় দল, তাঁর জনসমর্থন সব থেকে বেশি সেটা মাথায় রেখেই যাকে আমরা নৌকা মার্কা দেব যাকে আমরা নির্বাচনে প্রার্থী করবো তারপক্ষে সকলকে কাজ করতে হবে।’
কে প্রার্থী হলো সেটা বড় কথা নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আপনাদের এখন থেকেই জনগণের কাছে যেতে হবে নৌকা মার্কায় ভোট চাওয়ার জন্য।’ নৌকাই এদেশের মানুষকে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার, স্বাধীনতা এবং ভোট ও ভাতের অধিকার দিয়েছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রী মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে বাস্তুুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের পুণর্বাসনে তাঁর সরকারের উদ্যোগ এবং তাঁদের আশ্রয় প্রদানে স্থানীয় জনগণের সমস্যা লাঘবে সরকারের উদ্যোগও তুলে ধরেন।
নৌকার বিজয় হবে আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এত কাজ আমরা করেছি, যেভাবে দেশের উন্নয়ন আমরা করেছি। এরপরও নৌকা মার্কায় ভোট না পড়লে সেজন্য দলের প্রচার বিমুখতাই দায়ী হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী অতীতে জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে আগামীর নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে সে জন্য সচেষ্ট থাকার জন্যও দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহবান জানান।
তিনি বলেন, নির্বাচনে জনগণ ভোট দেবে। ‘ভোট চুরি, ভোটডাকাতি’- যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি-সেভাবে কেউ জিততে পারবেন না। আওয়ামী লীগ এ বদনাম নেবে না। জনগণ স্বতস্ফুর্ত হয়ে আপনাকে আপনার কাজে খুশি হয়ে ভোট দেবে।
তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে কেউ কিন্তুু ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। নির্বাচন যেন স্বচ্ছ হয়। নির্বাচন নিয়ে কেউ যেন কোন কথা বলতে না পারে।’
শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের মন জয় করে তাদের ভোট নিয়েই ক্ষমতায় আসতে হবে এবং উন্নয়ন কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
প্রায় দেড় ঘন্টার দীর্ঘ ভাষণে আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীকার আন্দোলনসহ সকল গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গৌরবদীপ্ত অতীতের স্মৃতি স্মরণ করেন ।
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এ দিনটিতে দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের কথাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তিনি।
সভায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাগত ভাষণ দেন। এর আগে দলের দপ্তর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ শোক প্রস্তাব পাঠ করেন। সভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম, কার্যনির্বাহী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও মহানগর, জেলা, উপজেলা, পৌরসভার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ চার হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।