রাশিয়ায় তৈরি হয়নি ভাষার সেতু

মত ও পথ

বিশ্বকে স্বাগত জানিয়ে ভাষার সেতুটাই তৈরি করতে পারেনি রাশিয়া৷ আরেকটি বড় সমস্যা দূরত্ব৷ পৃথিবীর ছয় ভাগের একভাগ স্থলের  দেশটির ১১ শহরে হচ্ছে বিশ্বকাপ৷ এর মধ্যে একটি ভেনু থেকে আরেক ভেনুর দূরত্ব মস্কো থেকে লন্ডনের চেয়েও বেশি৷

মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ এসেছি ১৮ জুন৷ ১৯ জুন সাতসকালে স্টেডিয়ামে গিয়ে জনে জনে এই জিজ্ঞাসা৷ বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে নির্মিত হয়েছে নতুন এই ভেনু্৷ ছবির মতো সুন্দর তা৷ ঐশ্চর্যমাখা৷ বাল্টিক সাগরের তীরঘেঁষা এই ‘ফ্লাইং সসার’ আভিজাত্য ঘোষণা করছে সদম্ভে৷ কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীদের কাজের জন্য অ্যাক্রিডিটেশনের ঝামেলা তো মেটাতে হবে আগে৷ মস্কো থেকে বিশ্বকাপের মূল অ্যাক্রিডিটেশন এনেছি; নতুন শহরের জন্য আবার কিছু আনুষ্ঠানিকতা মেটানোর পালা৷ স্টেডিয়ামের সৌন্দর্য উপভোগ বাদ দিয়ে, ঢাকায় লেখা পাঠানোর তাড়া তাড়িয়ে তাই আগে ওই খোঁজ৷ মিডিয়া অ্যাক্রিডিটেশন সেন্টার কোথায়?

যে কোনো সাধারণ স্টেডিয়ামের কর্মীদের জন্যই এ প্রশ্ন আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে না৷ অবহেলায় আঙুলের হেলনিতে দিক দেখিয়ে দেবে তারা– এই তো প্রত্যাশিত৷ আর এটি যখন বিশ্বকাপ ভেনু্, সহজ প্রশ্নের চটপট উত্তরই তো পাবার কথা৷ কিন্তু রাশিয়ায় দিন দশেক থাকার অভিজ্ঞতায় ততটা ভরসা করতে পারছিলাম না৷ আর আশঙ্কা সত্যি করে সত্যিই তো দেখি ওই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না কারো কাছে৷ যাঁকেই জিজ্ঞেস করি, প্রশ্ন শুনে মুখের রেখা যায় পাল্টে৷ যেন ক্লাস ওয়ানের শিশুকে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের প্রশ্ন করা হয়েছে৷ এ অগ্নিপরীক্ষার সামনে বড্ড অসহায় তাঁরা৷মূল কারণ, ভাষার ব্যবধান৷

বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে এরই মধ্যে দুই শহরের তিন ভেনু্তে তো যাওয়া হয়েছে৷ মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গের লুজনিকি স্টেডিয়াম, স্পার্তাক স্টেডিয়াম ও সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়াম৷ প্রতিবেদন তৈরির জন্য ছুটতে হয়েছে আরো কত জায়গায়৷ সর্বত্রই সবচেয়ে বড় সমস্যা ওই ভাষা৷ সিংহভাগ রুশ ইংরেজি বোঝেন না, বলেন না, জানেন না৷ বিশ্বকাপ কাভার করতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা সাংবাদিকদের সিংহভাগ আবার ইংরেজি পেরিয়ে রুশ বোঝেন না, বলেন না, জানেন না৷

ফলে যা হবার হচ্ছে তাই৷ একেবারে যাচ্ছেতাই৷ সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেডিয়ামে গিয়ে প্রথম দিন অ্যাক্রিডিটেশন সেন্টার খুঁজেই পেলাম না আর৷ ম্যাচ দেখে, মিডিয়া সেন্টারে কাজ সেরে পরের দিন সকালে আবার একই যুদ্ধে৷ লাল-নীল জ্যাকেটের ভলান্টিয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য৷ কেউ বলে ডানে যাও, কেউ বলে বাঁয়ে৷ স্যুটেড-বুটেড এক ভদ্রলোক তো সাহায্যের জন্য নিজের গাড়িতে চড়িয়ে পুরো স্টেডিয়াম ঘুরিয়ে কাঙ্খিত গন্তব্য হিসেবে এক জায়গায় ফেলে গেলেন৷ এ ক’দিনে শেখা গোটা কয়েক শব্দের রুশ শব্দভান্ডার থেকে ‘স্পাসিভা’ অর্থাত্‍ ‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে বিদায় দিলাম তাঁকে৷ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বুঝি, অ্যাক্রিডিটেশন সেন্টার মনে করে আমার চেনা মিডিয়া সেন্টারেই এনে ফেলেছেন ভদ্রলোক৷

এ অবস্থা সর্বত্র৷ সব জায়গায়৷ ভাষার ব্যবধান দূর হচ্ছে না কিছুতেই৷ রাশিয়ায় বিশ্বকাপ আয়োজন হচ্ছে বলে এ দেশের সবাইকে সার্বজনীন বৈশ্বিক ভাষা ইংরেজি শেখাতে হবে, এমন হাস্যকর দাবি কেউ করবে না৷ কিন্তু ভলান্টিয়ারদের তো অন্তত কাজ চালানোর মতো ইংরেজি জানতে হবে৷ বিশ্বকাপের আয়োজনের এ জায়গায় ডাঁহা ফেল করেছে স্বাগতিকরা৷ নিজেদের উঠোনে বিশ্বকে স্বাগত জানিয়ে ভাষার সেতুটাই যে তৈরি করতে পারলো না রাশিয়া!

আর সাধারণ মানুষের কথা কী আর বলার আছে! সাহায্য করার জন্য এক পায়ে খাড়া সবাই৷ কিন্তু ভাষাটা বুঝতে হবে তো! না বোঝার কারণে উল্টাপাল্টা দিকনির্দেশনা আর পরামর্শের শিকার হচ্ছি প্রতিনিয়ত৷ আর এরই মধ্যে বুঝে গেছি, বিশ্বকাপের শেষ পর্যন্ত এ ভাগ্য মেনে নিয়েই এগুতে হবে৷

বাংলাদেশে বিশ্বকাপ উন্মাদনা শুরু হয়ে যায় বিশ্বকাপের মাসখানেক আগে থেকেই৷ দেশ ছাড়ার আগেই তো দেখে এসেছি, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকদের রোমাঞ্চ৷ বাংলার আকাশ দখল করে রেখেছিল এই দুই দেশের পতাকা৷ ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্সের পতাকাও৷ আমাদের ওই ফুটবলপাগল জনতা রাশিয়া বিশ্বকাপে এলে ভিমড়ি খেতেন নিশ্চিতভাবে৷

এখন পর্যন্ত কোনো রাড়ি, অফিস, স্থাপনার ছাদে একটি পতাকাও উড়তে দেখিনি৷ তা না হয় উড়লো না, তাই বলে বিশ্বকাপের প্রচারণাও কি থাকবে না সেভাবে! মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গের স্টেডিয়াম এবং ফ্যান জোনের বাইরে বোঝার উপায় নেই যে, এখানে বিশ্বকাপ হচ্ছে৷ মস্কো থেকে ব্রোনিৎসি গিয়েছিলাম আর্জেন্টিনার বেসক্যাম্প ঘুরে আসার জন্য৷ ওই ছোট্ট শহরেও তো লিওনেল মেসির মতো মহাতারকার উপস্থিতির প্রমাণ নেই সেভাবে৷ সে কারণে আবার ওই জনে জনে জিজ্ঞাসা; আবার ভাষার দুর্লঙ্ঘ্য দুস্তর পারাবার; আবার দিক ভুলে, এদিক-ওদিক ঘুরে তবেই প্রার্থিত জায়গায় পৌঁছানো৷

২০১৮ বিশ্বকাপের আরেকটি বড় সমস্যা দূরত্ব৷ পৃথিবীর ছয় ভাগের একভাগ স্থল নিয়ে এ দেশ রাশিয়া৷ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ১১ শহরে হচ্ছে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো৷ এ এগারোর মধ্যে সবচেয়ে পশ্চিমের শহর কালিনিনগ্রাদ থেকে সবচেয়ে পুবের শহর ইয়েকাতেরিনবার্গের দূরত্ব মস্কো থেকে লন্ডনের দূরত্বের চেয়েও বেশি৷ ট্রেনে যেতে সময় লাগে ৩৬ ঘন্টা৷ সবগুলো শহরে আবার হাই স্পিড ট্রেন চলে না৷ আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের টিকেট পাওয়াও কঠিন৷ এক ভেনু্ থেকে আরেক ভেনু্তে যাওয়াটা তাই সমর্থকদের জন্য চাট্টিখানি কথা নয়৷ ২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপে যে সমস্যা ছিল না একেবারেই৷

সারা পৃথিবী থেকে আসা ফুটবলসমর্থকদের জন্য রাশিয়ার আবহাওয়াও বড় সমস্যা৷ বড্ড গোলমেলে তা৷ এই রোদ, এই বৃষ্টি৷ এই গরম, এই কনকনে শীত৷ রাশিয়ান গ্রীষ্মে এদেশের অধিবাসীরা রয়েছে বেশ আয়েশে৷ ফুটবলের অতিথিদের বেলায় তা বলা যাবে না কোনোমতেই৷

বর্ণবাদের সমস্যার সঙ্গে রাশিয়ার স্টেডিয়ামগুলোর লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ৷ প্রতিপক্ষের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের ব্যঙ্গ করা, তাঁদের উদ্দেশ্যে বাঁদরের মতো ডাকা, কলা ছুঁড়ে দেবার মতো ঘটনা অগুনতি৷ ২০১৩ সালে ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে এখানে খেলতে এসে এমন ঘটনার শিকার হয়ে ইয়া ইয়া তোরে বলেছিলেন, ‘‘এমনটা চলতে থাকলে কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলাররা এ বিশ্বকাপ বয়কট করতে পারে৷” জল অতোদূর গড়ায়নি৷ আর এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে বর্ণবাদ নিয়ে বড়সড় সোরগোলও হয়নি৷ টেররিজম-হুলিগানিজম নিয়েও ঝামেলা হয়নি খুব৷ কিন্তু টুর্নামেন্টের মোটে প্রথম সপ্তাহটি তো গেল৷ সামনের তিন সপ্তাহে তেমন কিছু যে হবে না, সে গ্যারান্টি দেবে কে!আশঙ্কা তুলে রেখে আশায় না হয় বুক বাঁধি৷ কিন্তু ভাষা নিয়ে আশাবাদী হতে পারছি না মোটেও৷ স্টেডিয়ামে, মেট্রোয়, উবারে, রেস্টুরেন্টে, মার্কেটে, সুপারশপে সামনের তিন সপ্তাহেও রুশ ভাষার সঙ্গে ইংরেজির দড়ি টানাটানি চলবে৷ নতুন ভেনু্তে গিয়ে অ্যাক্রিডিটেশন সেন্টার খুঁজে পেতে আবার দু’দিন লাগলে এবার আর অবাক হবো না!

 

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে