সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে || র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজে সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যম এক অপরিহার্য অঙ্গ। সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমকে তাই রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে। সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যম ব্যতীত কোন আধুনিক ও সভ্য সমাজ অকল্পনীয়। অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে স্বাধীন সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের কোন বিকল্প নেই। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া সুশীল সমাজও গড়ে উঠতে পারে না। রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকতা, স্বচ্ছতা ও জবাŸদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে স্বাধীন নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা আবশ্যক। মোদ্দাকথা এই যে, রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণ সাধনে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্ববহ। সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না গেলে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

সকল আধুনিক সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়ই সংবাদ মাধ্যম অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। সরকার কর্তৃক সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে কোন প্রয়াসই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে বাধ্য। অতএব, অর্পিত দায়িত্ব প্রতিপালনে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করাই হচ্ছে সভ্যতার দাবি। তবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা যেমন আবশ্যক, তেমনি স্বাধীনতা প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজস্ব সীমারেখা সম্পর্কে সচেতনতাও আবশ্যক। এ সীমারেখার দ্বারা আমরা কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বলতে যাব না। বরং অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে যেন অন্যের স্বাধীন সীমায় প্রবেশ না ঘটে সে বিয়য়ে সতর্কতা খুবই জরুরি। এ প্রসঙ্গে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারকে স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছেন ‘তোমার স্বাধীনতার সীমা সেখানেই শেষ যেথায় অন্যের স্বাধীনতার সীমা শুরু।’ অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমকে নিজ স্বাধীনতার কথা স্মরণে রাখার সাথে সাথে অন্যের স্বধীনতা যেন খর্ব না হয় সে বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। মোদ্দাকথা হলো- সংবাদ মাধ্যমকে হতে হবে দায়িত্বশীল।

universel cardiac hospital

দায়িত্বশীল সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সভ্য সমাজের প্রতীক। দায়িত্বহীনতা, জবাবদিহিতার প্রশ্নে উদাসীন, ব্যক্তির স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র স্বত্বাকে উপেক্ষা করার প্রবণতা গণতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে না। সুতরাং সংবাদ মাধ্যমকে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে নিজের স্বাধীনতার পাশাপাশি অন্যের স্বাধীনতর বিষয়টিও স্মরণে রাখতে হবে।

সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যম হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারের চোখ ও কান। মানুষের চোখ কান দিয়ে সব সময়ই সবকিছু ভাল দেখে বা শুনে তা কিন্তু নয়। চোখ কান খোলা থাকলে ভাল-মন্দ দুটোই চোখে পড়ে ও কানে আসে। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তিনি মন্দটা এড়িয়ে চলবেন কিনা। অনুরূপ প্রতিদিনকার খবরের উপর সরকারের প্রতিক্রিয়া কি হবে সরকার পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকেই তা ঠিক করে নিতে হবে।

একটা কথা আমরা জোরের সাথেই বলতে পারি যে, সংবাদ মাধ্যমে যে সব খবরাখবর বের হয় সাধারণ মানুষ তা কিন্তু আগ্রহ নিয়ে পড়ে এবং দেখে এবং নিজস্ব মতও গঠন করে ফেলে এ সব খবরকে কেন্দ্র করে। এই যে প্রতিদিনের সংবাদ মাধ্যমে টেন্ডরবাজি, চাঁদাবাজি, ভূমি দস্যুতার খবর আসছে, নিহত-আহত হওয়ার খবর আসছে তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। খবর আসে যে এই সব দুষ্কর্মের পেছনে মন্ত্রী ও সাংসদগণের ইন্ধন ও মদদ রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের নিষ্ক্রয়তায় সাধারণ মানুষের মাঝে সরকারের বিষয়ে এক ধরনের নেতিবাচকতা তৈরি হয়। সুতরাং নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকা নয়, এ সব খবর আমাদের রাষ্ট্র-সমাজের কর্ণধারদেরকে সতর্ক হওয়ারও সুযোগ করে দেয়। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার গুরুত্ব এখানেই। এটাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

অনুরূপ অন্য একটি বিষয়ও আমরা এখানে আলোচনা করতে চাই। অনেক সময় আমাদের সংবাদ মাধ্যমে ব্যক্তিবিশেষের সম্পর্কে অসত্য ও ভিত্তিহীন খবরাখবর পরিবেশন করে মানুষের চরিত্র হনন করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। খবরের সত্যাসত্য যাচাই না করে কোন সময় অজ্ঞতাবসত, কখনো উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে এ সব করা হয়। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার সুযোগে এবং সংবাদ মাধ্যমের ক্ষমতার সুযোগে এমন ধরনের কাজ কাম্য নয়। মানুষের যথার্থ মূল্যায়ন ও মর্যাদা না দিতে পারেন, কারও মর্যাদা ক্ষুন্ন করার স্বাধীনতা কাম্য নয়। সংবাদ মাধ্যমকে এ ব্যাপারে যতœশীল হতে হবে। দূর্ভাগ্যবশত আমাদের সংবাদ কর্মী বন্ধুদের অনেকেই বিষয়টিকে গুরুত দিতে চান না। তারা একবারও ভাবেন না যে, কোন ব্যক্তির চরিত্র হনন করতে গিয়ে একজনের শুধু নয়, ঐ ব্যক্তির পরিবার ও স্বজনদেরকে কতবড় সামাজিক জিজ্ঞাসার সম্মুখীন করে দিচ্ছেন। আমরা মনে করি ব্যক্তি মানুষের সম্পর্কে নেতিবাচক ও মর্যাদাহানিকর কোন কিছু প্রকাশের আগে ভাল করে যাচাই বাছাই করে নেওয়া উচিৎ। অথচ এ ব্যাপারে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনকি সংবাদ মাধ্যমের কর্তাব্যক্তিগণও একধরনের ঔদাসীন্য দেখিয়ে থাকেন, যা কোন ভাবেই সামাজিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে মেনে নেয়া যায় না। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় যারা আস্থাশীল, তারা চায় যে সংবাদ মাধ্যম দায়িত্ব শীল হোক এবং ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদার বিষয়েও যেন যতœবান থাকেন। তবেই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা মানুষের সমর্থন পাবে।

সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বলেই আমরা সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়টি সমর্থন করতে পারি না। প্রায়শই দেখা যায় যে, ক্ষমতাধরদের দ্বারা সাংবাদিকগণ লাঞ্চিত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের খবর আদৌ সুখকর নয়। এ জন্য ক্ষমতাধরদের অসহিষ্ণুতা ও ধৈর্যহীনতা যেমন দায়ী, কখনো কখনো সংবাদকর্মীগণ নিজেরাও কম দায়ী নন। তবুও আমরা মনে করি সাংবাদিক নির্যাতন অবাধ তথ্য প্রবাহ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থি। এটা গণতান্ত্রিক সমাজের গ্রহণযোগ্য আচরণ নয়। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজপতিদের মধ্যে অসহনশীলতা ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। গণতন্ত্রের স্বার্থে সাংবাদিক নির্যাতনের বিষয়টির অবসান হওয়া উচিৎ। গণতন্ত্র ও সরকারের প্রয়োজনেই সংবাদ মাধ্যম যেন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে সে পরিবেশ থাকা দরকার। কেননা গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমের বিকল্প নেই। আমরা মনে করি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সমাজ গঠনে দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। ক্ষমতাধরদের তথা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত গোষ্ঠির নিকট থেকে আমরা যেমন সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি প্রত্যাশা করব না, তেমনি সংবাদ কর্মী ও সংবাদ মাধ্যমের নিকট থেকেও আমরা মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মর্যাদা অহেতুক ও অকারণে ক্ষুন্ন হয় এমন কর্ম থেকে বিরত থাকার আশা রাখি। মোদ্দাকথা সংশ্লিষ্ট সকলকেই  সংবাদপত্র, সংবাদকর্মী, রাষ্ট্র, সরকার তথা সামগ্রিকভাবে ক্ষমতাবানদের সকলকেই আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সংহত করতে নিজ নিজ কর্ম প্রয়াস কাজে লাগাতে অনুরোধ করবো। তহলেই সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে এবং অবাধ তথ্য প্রবাহের অধিকারকে যথোপযুক্ত  গুরুত্ব দেয়া সম্ভব হবে।

সমাজের একজন দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে সংবাদপত্রের নিকট অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু আজকাল গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি অনেক সংবাদমাধ্যমই নিজেদের কাটতি বাড়ানোর জন্য চটকদার শিরোনাম ব্যবহার করে। ফলে বাজার কাটতির নামে মূল খবরের গুরুত্বটাই হারিয়ে যাচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করছি উন্নয়ন সাংবাদিকতার অভাব। অথচ সংবাদ মাধ্যমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হচ্ছে উন্নয়ন সাংবাদিকতা। আমার কেন জানি মনে হয় আজকাল সংবাদপত্রগুলো অনুসন্ধানী সংবাদের চেয়ে অনেক বেশি অনুষ্ঠান নির্ভর সংবাদ পরিবেশনে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ বিষয়ে মনোযোগী না হলে সংবাদমাধ্যম যে চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে তা আরো বেশি শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

সংবাদপত্রকে আমি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আশা ভরসার স্থল মনে করি। তাই আশা করবো- সংবাদমাধ্যমে সবাইকে সমান গুরুত্ব দিয়ে দেশ ও সমাজ গঠনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় সংসদ সদস্য এবং সম্পাদক, পাক্ষিক মত ও পথ।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে