আমি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছি। দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে আমার কবিতা।
একদিকে রয়েছে নিতান্ত ব্যক্তিগত উচ্চারণ, অথবা স্বগতোক্তি কোনও, যার যা-মনে-হয় বলে ফেলা ছাড়া আর কোনও দায় নেই, আর কোনও ক্ষমতাও নেই। সে আমার নিভৃত লেখালিখি, পাঠকের কাছে যদি তা আদৌ পৌঁছায়, সেও তার নিভৃত পাঠ। তার মধ্যে সংকেত আছে, ইশারা আছে, বলেও না বলা আছে। পাঠকে পাঠকে তার পাঠভেদ আছে। এমনকি একই পাঠক সকালে পড়লে তার একরকম ব্যঞ্জনা, বিকেলে তার অন্য অর্থ অনুভব করতে পারেন। এমনকি আমি যা ভেবে লিখেছি, পাঠকের কাছে তা অন্য ভাবনায় সম্পূর্ণ রূপান্তরিত, হয়ত বা বৃহত্তর অর্থ নিয়ে পৌঁছে যেতে পারে। এ কবিতা কিছুটা জটিলও হতে পারে, তির্যক হতে পারে, কিন্তু তার একটা সামগ্রিক আবেদন থাকে। যা কেউ বোঝে কেউ বোঝে না। কেউ না বুঝলেও এই কবিতার কিছু যায় আসে না।
আরেক রকম কবিতা আছে, যা সোচ্চার। সে সরাসরি কথা বলতে চায়। সে নিমগ্ন পাঠকের নিবিড় পাঠের অপেক্ষা রাখে না। সে মানুষের স্বর হয়ে উঠতে চায়। সেখানে কবিতা প্রতিবাদে প্রতিরোধে প্রতিশোধে জনমানুষের হাতিয়ার হওয়ার দায়িত্ব পালন করে। রাজনৈতিক বক্তৃতা যতটা পারে, ছন্দোবদ্ধ লড়াকু কবিতার ক্ষমতা তার চেয়ে বেশি বই কম নয়। তা মানুষকে উজ্জীবিত করে, সংগ্রামের আবেগে উদ্বেলিত করে। এই কবিতার উদ্দেশ্যই তাই। এইই তার সার্থকতা। এ লেখা কেউ মানুন বা না মানুন, মানুষ বোঝে। সে তৎক্ষণাৎ পাঠকের সঙ্গে কিংবা শ্রোতার সঙ্গে মানসিক সেতু স্থাপন করে।
এখন বিষয় হচ্ছে, আমি দুরকম কবিতাই লিখি। হ্যাঁ, আমার পুরনো লেখা সবই ব্যক্তিগত। সেখানে প্রেম ও প্রেমহীনতা, জীবন ভাবনা, মৃত্যুচিন্তা, আনন্দ ও বেদনা, উল্লাস ও অবসাদ… এগুলিই মূল উপজীব্য। আমার এ যাবৎ প্রকাশিত খান পঁচিশেক কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি এমনটাই। আরও দুটি বই রয়েছে রাজনৈতিক তথা প্রতিবাদী কবিতার। এ কথা বলার কারণ, আমি ফেসবুকে সেরকম ব্যক্তিগত কবিতা সাধারণত পোস্ট করি না। তাতে কেমন যেন একটা ভুল বার্তা পৌঁছায়।
কবিতার মতো আমার পাঠকেরাও দ্বিধাবিভক্ত। কেউ আমার ব্যক্তিগত কবিতা পছন্দ করেন, যার রসগ্রহণ সাধারণ মানুষ হয়তো তেমন করতে পারেন না। এই সকল পাঠক আমার প্রতিবাদী লেখাপত্রের বিরোধী। তাঁদের অনুযোগ, আমি কেন আজকাল বিশুদ্ধ ( সাহিত্যসম্মত) কবিতা লিখছি না। সাহিত্যে মনোযোগ দিচ্ছি না। এঁরা আমার ওপর প্রত্যাশা রাখেন, তাই সাহিত্যগুণসম্পন্ন কবিতা না লিখলে বিরক্ত হন। বিরূপ মন্তব্য করেন। আর প্রতিবাদের সহজবোধ্য কবিতা সেইসব সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায়, যাঁরা সাহিত্যরসের তোয়াক্কা করেন না। কবিতায় তাঁদের প্রাণের কথা বললে আনন্দিত হন। আমাকে, আমার কবিতাকে পছন্দ করেন, নিরন্তর উৎসাহ দেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কোনদিকে যাব। উত্তর হচ্ছে, আমি নিজের দিকে যাব। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কার জন্যে লিখব। উত্তর হচ্ছে, আমি আমার জন্যে লিখব। আমার প্রেম নিয়ে লিখব, আমার প্রতিবাদ নিয়ে লিখব। মানবিকতা নিয়ে লিখব, মানবাধিকার নিয়েও লিখব। মোট কথা যা লিখব বিবেকের কাছে সৎ থেকে লিখব। এভাবে যেখানে যত পাঠক আছেন, তাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমার কবিতা চাইলে তুলে নেবেন, না চাইলে ফেলে দেবেন। আমার কিন্তু এই দুরকম কবিতা নিয়েই পাঠককে ছোঁয়ার আশাটুকু দ্বিপার্শ্বীয়প্রতিসম।
লেখক পরিচিতি:
কবি মন্দাক্রান্তা সেন এর জন্ম ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭২, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ। তিনি ১৯৯৯ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে ‘আনন্দ পুরস্কার‘ পান । ২০০৪ সালে তিনি ‘ভারতীয় সাহিত্য আকাদেমি ‘ থেকে ‘ সুবর্ণজয়ন্তী ইয়ং রাইটার্স পুরস্কার ‘ লাভ করেন। পরে অবশ্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি ফিরিয়ে দেন।
প্রকাশিত বই:
অন্ত্যাখড়ি (২০০৫), চাঁদের গলায়ে শালা দারি (২০১৩), দলছুট (২০০২), বল অন্যভাবে (২০০০), হৃদয় অবাধ্য মেয়ে (১৯৯৯), উপন্যাস সমগ্র (২০১৩), আফটার দ্যা লাস্ট কিস্ (২০১৫), প্রেমের কবিতা (২০১৫), কলকব্জা (২০১৪), মাই হার্ট ইস আ আনরুলি গার্ল (২০১৬), ছদ্ম পুরাণ, উতসারিত আলো (২০০১), এসব-ই রাতের চিহ্ন, কাশভরা বন্ধুতারা (২০০২), ঝানপাতাল (২০০০), সহবস্থান (২০০৩)
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া