বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টেফান ব্লম বার্নিক্যাট ডিপ্লোমেটিক করেসপন্ডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের এক অনুষ্ঠানে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি নির্বাচন নিয়ে ইংরেজিতে যা বলেছেন তার সারবক্তব্য হলো- “আমরা যখন খুলনা এবং গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে প্রশংসা করছি তখন জাল ভোটে ব্যালট বাক্স ভরার মত অনিয়ম এবং ভোটের আগে ও ভোটের দিন প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের হয়রানির খবর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও পোলিং এজেন্টদের গ্রেফতার ও হয়রানির খবর নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।”
উল্লেখ্য, খুলনার সিটি কর্পোরেশনের নিবর্বাচনের পর তাকে এতটা মুখ খুলতে দেখা যায়নি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধির এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলতে চেয়েছেন যে গাজীপুর এবং পূর্বে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। সেই সঙ্গে তাকে নিজের চরকায় তেল দিতেও সুপরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি পুকুর চুরির অভিযোগ এনে কান্নাকাটি করছে। তারা নির্বাচন বাতিল করে পুণঃনির্বাচনের দাবিও জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে সরকারের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়েও অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। যদিও তারা ঠিকই আরো তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই করে মনোনয়ন দিয়েছেন।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে স্থানীয় সরকারের সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সামনে আরো তিনটি নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। অনেকেই বলেন- স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। কথাটি ঠিক না। বাংলাদেশের রাজনীতির ধরণ অনুযায়ী অবশ্যই আছে। তাছাড়া দলীয় প্রার্থীর মনোনয়ন যেদিন থেকে চালু হয়েছে, ঠিক সেই সময় থেকে স্থানীয় নির্বাচন আর রাজনৈতিক নির্বাচনের বাইরে নেই। এটা অস্বীকার করা যাবে না। অবশ্য আগেও অনানুষ্ঠানিকভাবে স্থানী সরকারের প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক আশীর্বাদ প্রয়োজন হতো। সুতরাং সবকিছু মিলে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন অনেক রাজনৈতিক বার্তা বহন করছে।
নির্বাচনের ঠিক আগে বিএনপির লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইলেকশন কমিশন জেলা প্রশাসনকে, বিশেষ করে পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়ে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের ধড়-পাকড় থেকে বিরত থাকিতে নির্দেশ দেয়। সে নির্দেশ কতটা মানা হয়েছে অথবা আদৌ মানা হয়েছে কি না; নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং গাজীপুর সংশ্লিষ্ট আওয়ামী লীগের নেতাদের কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা, নির্বাচনে কোন দল কতটা টাকার খেলা খেলেছে, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য সঠিক কিনা; এবং সঠিক না হলে কেন তা সঠিক নয়- সেইসব পয়েন্ট ধরে বিএনপি এবং মার্সিয়া বার্নিকেটের আগানোা উচিত ছিল। তা না করে দুটি পক্ষই ঢালাও মন্তব্য করেছেন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, কিছু অনিয়ম ছাড়া নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠ হয়েছে। ইসি বলছে, নির্বাচন নিয়ে তারা সন্তুষ্ট। তাহলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী করতে পারেন? তিনি নির্বাচন কমিশন, বেসরকারি পর্যবেক্ষক দল এবং নিজ দলের নেতাকর্মীদের কথায় আস্থা না রেখে চোখা মিয়ার ছেলের কথায় বিশ্বাস রেখে, বার্নিক্যাট ম্যাডামকে সন্তুষ্ট করতে নির্বাচন বাতিল করবেন? বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কোন নির্বাচন আছে যেই নির্বাচন তথাকথিত অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ হয়েছে? আমি আমার জীবনে কখনো দেখিনি যে কোনো একটি নির্বাচনে কারচুপি হয়নি। বরং বহুবার দেখেছি ভোট কেন্দ্র দখল করে বেলা ১২ টার মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেছে! আর সেই সব নির্বাচনের উপর ভর করে জিয়াউর রহমান, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া দেশ চালিয়েছেন দিব্বি। তখন কি বার্নিকেট আপা এখানে ছিলেন? না। তিনি ছিলেন না, কিন্তু তার পূর্বসূরীরা ছিলেন। তারা তাদের সুবিধামত সেসব নির্বাচন নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। আর জিয়া-এরশাদ-খালেদারা সম্পূর্ণরূপে যুক্তরাষ্ট্রের তল্পিবাহক হিসাবে দেশ চালিয়েছেন।
এখন বার্নিকেট আপার মর্জ্জি কী? তিনি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে আমাদের কী ইঙ্গিত করতে চাইছেন? শেখ হাসিনা সরকার কথা শোনে না তাই একটু চাপে রাখা? নাকি তিনি বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে বিএনপি এবং সমমনা দলগুলোকে একটু সান্তনা দিলেন? পরেরটাও হতে পারে। একবারে ফেলে দেওয়া যায় না।
একটি বিষয় কি বার্নিক্যাট আপা লক্ষ করেছেন? নির্বাচনে অনিয়মের ব্যাপারে বিএনপি প্রথমে দু-চারটি বলে পরে শতাধিক কেন্দ্রে অভিযোগ এনেছে। পরে দুই শতাধিক কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। এ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিল ৪২৫ টি। সেক্ষেত্রে বাকী যেসব কেন্দ্রে ছিল, সেখানে বিএনপির ভরাডুবি হল কেন? পরিক্ষামূলকভাবে যে ইভিএম মেশিনে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে সেখানেও বিএনপির প্রার্থী হারলেন কেন?
যুক্তরাষ্ট্রের অজানা থাকার কথা না যে বিএনপি দল হিসাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শয্যাশায়ি দল। তথাপি যুক্তরাষ্ট্র ভোটের গণতন্ত্র বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু মুশকিল হলো খোদ যুক্তরাষ্ট্রে কেন সেই ভোট বা নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ থাকে না? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়া নিয়ে এখনো সেদেশে রীতিমতো যুদ্ধ চলছে। পাল্টাপাল্টি অ্যাকশন চলছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছেন তা এখন সর্বজন বিদিত। ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ার সাইবার এটাক এবং হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করার সেই বিতর্ক এখনো আছে। কেউ কেউ ভেবেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হতে পারেন, কেউ ভেবেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। ট্রাম্প সাহেবই বহাল আছেন। যুক্তরাষ্ট্রের লেখক ও সাংবাদিক বারি সেগাল লিখেছেন,
“The United States has held 56 presidential elections to date. Some you’ve heard about, some you haven’t. When you think of controversial elections the most recent ones likely come to mind, but the United States has been having contentious presidential elections since, well, the beginning.”
তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি না যে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিতে আমাদের বিব্রত হওয়ার কিছু আছে। সামনের দিনে জাতীয় নির্বাচন জটিলতাও নেই। বার্নিক্যাট যা করেছেন তা অনেকটা রুটিন কাজ। বিএনপির এতে বিশাল আত্মসন্তোষ্টির কোনো কারণ নেই। জাতীয় নির্বাচন নিয়েও এই রুটিন বক্তব্য দেওয়ার জন্য মার্কিন দুতাবাস প্রস্তুত আছে।
তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র অস্বস্তিতে পরলে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের কী করার আছে? জাতীয় নির্বাচন চলে এসেছে প্রায়। পার্লামেন্টে পাস করার মধ্য দিয়ে সংবিধানে বলা হয়েছে, নির্বাচন হবে সিটিং প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। এই সংশোধনী আনার সময় বহু কথাবার্তা হয়েছে, বহু বিরোধী রাজনীতিক বিদেশিদের কাছে নালিশ করেছেন। তখন তো বিষয়টি নিয়ে কোনো সুরাহার পথ যুক্তরাষ্ট্র বা সমমনা দেশগুলো দেখাতে পারেনি!
গাজীপুরে প্রকৃতপক্ষে যা হয়েছে তা হল অতি-উৎসাহী লোকেরা ভোট কাটাকাটি করেছে কিছু কেন্দ্রে। এর মানে গোটা গাজীপুরের মানুষের স্বতস্ফূর্ত ভোটপ্রদান অস্বীকার করা নয়। এই অতি উৎসাহীরা সর্বদাই ছিল এবং আছে। এটা প্রশাসনের যারা নিযুক্ত ছিলেন তাদের ব্যর্থতা।
১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আমরা ভুলে যেতে চাই। সঙ্গে একথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। বাংলাদেশের মানুষ এখন সাহায্য খায় না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা এখন হাটু নয়, মাথা দিয়ে চিন্তা করে। দেশে মানুষের মধ্যে কোনো অস্থিরতা নেই। বহু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এখন এতটাই ভালো সম্পর্ক যে ইচ্ছা করলেই দেশের প্রধানকে কোনো দেশ চক্রান্ত করে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে না। সুতরাং কোনোদিকে কান না দিয়ে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন দিয়ে এবং জনগণের মন জয় করে ভোট নিয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক