খালেদ হোসাইন এর একগুচ্ছ কবিতা

খালেদ হোসাইন, জন্ম : ১৯৬৪, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ
আমার  কবিতা-ভাবনা

কবিতাকে নিয়েই আমার ঘর-সংসার- জীবন-যাপন। এর মানে এই নয় যে, কবিতালক্ষ্মীকে আমি ঘনিষ্ঠতম নৈকট্যে পেয়ে গেছি। আমি আমার চারপাশের সমুদয় বস্তু-বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে ক্রমাগত ছুটে চলেছি তার দিকে। এ-ছাড়া আমার অন্য কোনো গন্তব্য নেই, এছাড়া আমার আর কোনো আরাধ্য নেই। আমার বেঁচে থাকবার জন্য প্রথম মৌলিক চাহিদা কবিতা। তাই আমি কবিতার কাছে যাই, সুরম্য কোনো রাজপ্রাসাদ বা পাতার ছাউনির সামনে দাঁড়িয়ে, আর্তনাদ করি, ‘আমাকে গ্রহণ কর, আমাকে ধারণ কর।’ কখনো মনে হয়, স্মিত হাস্যে সে আমাকে ঘরের আর মনের দরোজা খুলে দিয়েছে, কখনো মনে হয়, না, এ এক মায়াবী মরীচিকা। তপ্ত বালির খাদে মুখ থুবড়ে পড়ে আছি। আমার খুব অভিমান হয়। আমি তো তোমার সঙ্গে কখনো ছলনা করিনি, কবিতা!

হৃদয়ের মধ্যে তীব্র কোনো চাপ অনুভব না করলে, তা প্রকাশের অপ্রতিরোধ্য কোনো আর্তি অনুভব না করলে তো আমি তো কখনো কবিতা লেখি না। রবীন্দ্রনাথের কথা তো আমি বিশ্বাস করি, ‘এও কি বোঝাতে হয়, প্রেম যদি নাহি রয়, হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান।’

হৃদয় আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান, হৃৎপিণ্ডের চাইতে। কিন্তু সেই হৃদয়ে কেবল ব্যক্তিগত যন্ত্রণাই অভিঘাতের পর অভিঘাত সৃষ্টি করে না, আমার চারপাশের মানুষজন তাদের জীবনাকাঙ্ক্ষা, বঞ্চনার বেদনা আর প্রত্যাশার অগ্নিমশাল জ্বেলে সমবেত হয়। তাদের ঘর্মাক্ত, রক্তাক্ত, বিদীর্ণ মুখচ্ছবিও আমাকে বিহ্বল করে, আমার হদয়ের গভীরতম পরিধিতে একটি অগ্নি-স্ফূলিঙ্গ বপন করে দেয়। সেই যন্ত্রণায় আমি তড়পাতে থাকি, আমার দিন-রাত এলোমেলো হয়ে যায়, চারপাশের দৃশ্যসমুদয় পরাবাস্তব হয়ে ওঠে। রাজনীতির ভণ্ডামি, মানুষের অমানবিকতা, আমাকে কাতর করে তোলে। তখন এই মধ্যবিত্ত দোলাচলপ্রবণ মন কোথায় আশ্রয় প্রত্যাশা করতে পারে, কবিতা, তোমার সান্নিধ্যের কোমল ছায়া ছাড়া? তাই, আমি কবিতার কাছে যাই। এই যাওয়া আসলে এক অন্তহীন পথ-পরিক্রমণ, আমি জানি। আমি জানি, এক-জীবনে অনেক বেশি পথ অতিক্রমও করতে পারে না মানুষ। মানুষের আকাঙ্ক্ষার তুলনায় দু-এক শ বছরে জীবন-পরিধি নেহাতই তাচ্ছিল্যকর। আর এটাও জানা হয়ে গেছে, ব্যক্তি-মানুষের মৃত্যু অনিবার্য হলেও তাতেই সবকিছু ফুরিয়ে যায় না, মহৎ হৃদয় থেকে উত্থিত আশার কোনো মৃত্যু নেই, আর তাকে ধারণ করে রাখে যে কবিত, তারও কোনো মৃত্যু নেই। এমন একটি-মাত্র কার্যকর কবিতার জন্য আমি জীবনপাত করতে পারি, করতে চাই।

প্রত্যেক কবিই নিজের মতো কবিতা লেখেন। তাঁদের সকলেই স্বতস্ত্র, অভিনব, যদি কবি-ই হন। কিন্তু কবিকে প্রথমে হয়ে উঠতে হয় স্বাদেশিক। আমি বিশ্বাস করি, ঐতিহ্য-বিচ্ছিন্ন কোনো করিৎকর্মা লোক, শিল্পী হতে পারেন না। নিজের দেশের মাটিতে তার শেকড়কে চাড়িয়ে দিতে হয়, মৃত্তিকারস আস্বাদন করে পরিপুষ্ট হয়ে উঠতে হয়। কিন্তু দেশ মানে কোনো ভৌগোলিক সীমানা-মাত্র নয়। তার মানুষ, নিসর্গ-প্রকৃতি, সংস্কৃতিকে আত্মীকৃত করেই কবিকে দেশোত্তর, কালোত্তর ও সার্বভৌম হয়ে উঠবার সাধনা করতে হয়। মধ্যবিত্ত-মদিরা-মদির পিছুটানময় জীবনে সেই সাধনা সহজসাধ্য নয়। তাই কবিকে ক্রমাগত শেকলের পর শেকল ছিঁড়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। ছিন্ন করতে হয় নানান বন্ধন। একই সঙ্গে থাকতে হয় নানা প্রলোভনের হাতছানি থেকে। সামাজিক জীবনের কাঠামোতে বন্দি থেকেও, যখন তিনি কবিতা লেখেন, তখন তিনি সমাজোত্তর হয়ে ওঠেন। গড়-পরতা সামাজিক মানুষের জীবন তাঁর নয়। এমন যাঁরা কবি, তাঁরাই আমার পূর্বসূরী। কবিতার এ অন্তহীন ব্রতযাত্রায় আমি কোনো পথিকৃৎ নই, একজন গোঁয়ার ও গন্তব্য-অবিস্মৃত এক পথচারী মাত্র। জানি, আমি একদিন ফুরয়ে যাবো, পথ ফুরোবে না। ফুরোবে না পথচলা। আমারও নয়।




আমাকে অথবা তোমাকে বলছি

তুমি যখন তাকাও-
আকাশ বা মেঘমালা দেখবে বলে
টের পাও তোমার পায়ের নিচে বয়ে যাচ্ছে তীব্র ফল্গুধারা?
এইভাবে ঢাকা থাকে কিছু দৃশ্য-
অনন্ত ইশারা। কেননা অন্তর সে-ও
অন্তরালে থাকে
তবু কেউ টের পায়-
কেউ তাকে ডাকে।

নিশ্চয় দেখেছ তুমি চাঁদে মেঘে
থাকে লুকোচুরি
নিশ্চয় জেনেছ তুমি মন এক স্বেচ্ছাচারী ঘুড়ি।

বাঁধাপথ পেলে পরে গাধারাও কলরব করে
যে-কোনো নতুন পথে
ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ে। 

কোথাও সঙ্গীত নেই- চারপাশে মূর্খতার চাষ
নিজে পথ না বানালে বইবে না কোনো সুবাতাস।


স্বপ্নে খানিক ঠাঁই দিও

আমাকে একটু ঠাঁই দাও না তোমার স্বপ্নে!
চুপটি করে বসে থাকবো রাত্রিভর।
স্বল্পে তুষ্ট মানুষ আমি, তেমনকিছু চাইবো না
দেখবো তোমার লীলালাস্য কী বিচিত্র রঙ-বেরঙ!

যা খুশি তা কোরো তুমি যেমন করো নিত্যদিন
স্নানঘরে বা রান্নাঘরে আমার দুচোখ কী নির্মল
পোশাক পাল্টে শাড়ি পরো কপালে টিপ এব্বড়ো
ঠোঁটে একটু লিপিস্টিক আর চোখে কাজল-এই তো, না?
ইচ্ছে হলে আমরা সঙ্গে ঝগড়া কোরো কিছুক্ষণ
দেখবে কতো শান্তি লাগে-নেই প্রতিবাদ সামান্য
ভয় পেয়ো না, স্বপ্নই তো, জাগলেই তো থাকবো না!
যারা খুবই গোয়েন্দা কী খুঁজে পাবে মাল-সামান?

হৃদয় থেকে ঘরে বা নয় ভুবন থেকে ভবনে
আমার চাওয়া চুনোপুঁটি স্বপ্নে খানিক ঠাঁই দিও

একটু শুধু কাটবো সাঁতার নিবিড় জলে আনন্দে
কী ক্ষতি হয় বাস্তুহীনকে একটু দিলে আস্তানা?

কুয়াশার মতো নিস্তব্ধতা   

নিস্তব্ধতা তৈরি করে নিতে হয়।

যা তড়িঘড়ি আসে, তা তড়িঘড়ি চলে যাক।
তুমি দুয়ার খুলে বলো, ‘আবার দেখা হবে।’
তুমি তো জানো, কারো সঙ্গেই
দ্বিতীয়বার দেখা হয় না।

গাছে গাছে বৃষ্টিধোয়া নতুন পাতা।
এখনো লেকের জল ঘোলা হয়ে ওঠেনি।
আরেকটু গভীরে গেলে স্পষ্ট হবে
মাছেদের চলাচল।

এই ভরদুপুরে ঝিঁঝি ডেকে উঠলে
কান পেতে দিও।

কতো কতো অভিমান চারপাশে!
একদিন বোঁটা শুকিয়ে যাবে-
খসে পড়বে
বাতাস তাকে নিয়ে যাবে অন্য কোনো সীমান্তের পরপারে।

একটু স্থিত হও। স্থির হও।
চিত্তচাঞ্চল্যকে ঘুমিয়ে পড়ত দাও।
অন্তরে ও বন্দরে আরেকটু নির্জনতা নামুক।

তোমার চোখের পাতায় খুব ক্লান্তি জমে আছ।
দেখবে, সেখানে পুঞ্জিভূত হচ্ছে কুয়াশার মতো নিস্তব্ধতা।


আত্মাকে বিদ্ধ করা ছাড়া কোনো গন্তব্য নেই

অন্যের কষ্ট বুকে নিয়ে তুমি ঘুমাতে যাও।
অন্যের স্বপ্নভাঙার যন্ত্রণায় তুমি ছটফট করো।

আলো নিভিয়ে দিয়েছ। না নিভালেও এখানে
কৃষ্ণপক্ষ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অবচেতন থেকে

শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসতে চায়
কতিপয় কবিতার পংক্তি। অনুভূতির ঝোড়ো

ঝাপটায় তুমি তাদের সরিয়ে দাও। দূর থেকে
ভেসে আসে সুর, করুণ ও বিদারক। তুমি

ঘরের সব ফুঁটো বন্ধ করে দাও, তবু তাকে
দমাতে পারো না। কান চেপে ধরো। না-

তবু তা তোমাকে বিস্ত্রস্ত করে দেয়। তুমি
বুঝতে পারো আত্মাকে বিদ্ধ করা ছাড়া

তোমার আর কোনো গতি নেই, গন্তব্য নেই।

অন্ধবোধ

কোথায় যেন যাচ্ছি আমরা।
তুমি আমি আমরা সবাই।
বিচার করো আচার করো
দা চাপাতি করছে জবাই।

কোথায় যেন যাচ্ছি আমরা
সামনে পিছে ডাইনে বাঁয়ে
যার যেখানে যাওয়ার কথা,
সেখানে নয়- পথ হারায়ে

পথ হারালে পথেই থাকি
পথ নিয়ে যায় দ্বন্দ্ববোধে
কিন্তু তা তো গন্তব্য না
তাই তড়পাই অন্ধবোধে।

অলঙ্করণ : রাজিব রায়

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে