বিএনপির সামনে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থেকে অযথা ইস্যু বানানোর কসরতে থাকা দলটি দিন দিন রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়ে তুলছে। চলমান রাজনীতিতে দিন দিন পিছিয়ে পড়া বিএনপির এই দুর্দশা নিয়ে রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা অভিমত ব্যক্ত করে বলছেন, সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যদি বিএনপি জয়লাভ করে তাহলে কি দলটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে? এর আগে অবশ্য দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি তো রয়েছেই। তারা আরও বলছেন, বিএনপি কি খালেদা জিয়াবিহীন কোন জাতীয় নির্বাচনে যাবে কিনা তা নিয়ে কার্যত দলের নেতারা বর্তমানে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বের একটি বড় অংশ মনে করছে আগামী সংসদ নির্বাচনে শাসক দল আওয়ামী লীগকে কোনোভাবেই দশম সংসদ নির্বাচনের মতো বিনা ভোটে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হবে না। তবে দলটির অন্য একটি অংশ চাচ্ছে এ সরকারের অধীনে খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপি কোন ধরনের নির্বাচনে অংশ নেবে না। মূলত দলের ভেতর এই দ্বন্দ্ব সংঘাতে বিএনপি না পারছে ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন করতে না পারছে আন্দোলন সংগ্রাম করে চেয়ারপারসনের মুক্ত করতে। বর্তমানে বিএনপির নেতৃবৃন্দ এই দুই ধারায় দ্বিধা বিভক্ত।
এদিকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত থাকা অভিজ্ঞরা বর্তমানে দলটির নেতৃবৃন্দের জনবিচ্ছিন্নতাকে মোটাদাগে চিহ্নিত করে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, বিএনপির রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একাধিক সুবিধাবাদী চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে আছে বিধায় দলটি অতীতের আন্দোলন সংগ্রামের চিরচেনা পথে হাঁটতে পারছে না। দলের মধ্যে নেতায় নেতায় দূরত্ব, বিভাজন, চেইন অব কমান্ড না থাকা আর গ্রুপিং এখন ওপেন সিক্রেট। দলটির মধ্যম সারির নেতারা নিজেদের ‘ভাইয়া’ অনুসারী তকমা দিয়ে সিনিয়র নেতাদের সাইড লাইনে বসিয়ে রাখার নীতি অবলম্বন করছে। অভিজ্ঞরা আরও বলছেন, দলের চেয়ারপারসনকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনতে দলের নীতিনির্ধারকদের দ্বৈতনীতি দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এসব নেতাকর্মীরা চেয়ারপারসনকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনার ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কথাও বিভিন্ন ফোরামে বলছেন।
এদিকে ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে তা নিয়েও বিএনপি এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য কোন চূড়ান্ত প্রস্তাবনা সরকারি দলকে দিতে পারেনি। এছাড়া নির্বাচনকে ঘিরে নিজেদের কি করণীয় তা এখনও ঠিক করে উঠতে পারছে না বলে দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সূত্রগুলো জানায়, নয় বছরের শাসনামলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক পরিপক্কতার ব্যবধান অনেক বেড়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের সঙ্গে মনস্তাত্তিক দূরত্বেও বিএনপি অনেকটাই পিছিয়ে আছে। সূত্রগুলো মনে করছে বিগত দিনের ইস্যুভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সীমাহীন ব্যর্থতা দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এসব নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তারা দলের বিভিন্ন ফোরামে সিনিয়র নেতাদের বিতর্কিত ভূমিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখছেন। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে দলের নেতৃত্বে থাকা পদ দখল করে থাকা সেমিনার আর বক্তৃতা সর্বস্ব মুখচেনা নেতারা দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ব করতে পারছেন না । এসব নেতারা দেশের সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টও পড়তে পারছেন না। তারা বলছেন, দিন যত যাচ্ছে বিএনপির এসব নেতারা যেন ততই এই ধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। তারা এসব নেতাদের হাত থেকে দলকে মুক্ত করতে চান।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কি হবে তা ঠিক করেই নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বলছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে- এর অন্যথায় হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তারা আরও বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি সংসদ সদস্যরা স্বপদে থাকবেন এবং মন্ত্রীসভা বর্তমানের চেয়ে আরও সংকুচিত হয়ে একাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে সরকারি দলের এই অবস্থানের বিপক্ষে অনড় রয়েছে বিএনপি। দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় অন্যথায় নয়। এক্ষেত্রে নির্বাচনের তিন মাস আগে সরকার ভেঙ্গে দিয়ে অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের কথাও বলা হয়েছে। এর সপক্ষে তারা বলছে বিগত দিনের স্থানীয় সরকার, সিটি কর্পোরেশন সহ অন্যান্য নির্বাচনে সরকার যে স্বেচ্ছাচারীর ভূমিকা নিয়েছে তা আর তারা দেখতে চান না।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমে এ বছরের অক্টোবরে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তিনি এও বলেছেন সংবিধান মেনে নিয়ে গঠিত এই সরকার পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর আওতায় থাকবে।
আওয়ামী লীগ নেতার এই কথায় বিএনপি নেতারা নড়েচড়ে বসেছেন। তারা বুঝে ফেলেছেন সরকার দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার কথার অর্থ। বিএনপি নেতারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন সরকারি দল তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ নিষ্কণ্টক করতে আটঘাট বেধে, দিক নির্দেশনা ঠিক রেখে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে নির্বাচনের পথেই হাঁটছেন। এ প্রসঙ্গে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান গণমাধ্যমে ওবায়দুল কাদেরের কথার জবাবে বলেছেন, সরকার যদি এভাবে বিরোধী দলের মতামতকে তোয়াক্কা না করে একের পর এক ভুল সিদ্বান্ত নিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো আরেকটি নির্বাচনের দিকে হাঁটতে থাকে তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য বিপদজনক ফল বয়ে আনতে পারে।
রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলটি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নাকি তাঁকে মুক্ত করে বের করে নিয়ে এসে আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে তা নিয়ে কার্যত বিএনপির মধ্যে মতান্তর দেখা দিয়েছে। দলের মধ্যে প্রভাবশালী বলে চিহ্নিত অংশটি বিগত দিনে নিজেদের আন্দোলন সংগ্রাম করে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আনতে না পারার ব্যর্থতাকে আড়াল করতে বলছে, চেয়ারপারসনকে কারাগারে রেখে দল নির্বাচনে গেলে মানুষের সেন্টিমেন্ট দলের পক্ষে আসবে। এক্ষেত্রে তারা নব্বই পরবর্তী নির্বাচনে এরশাদের জেলে থাকার বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে আনছেন। অন্যদিকে দলের একটি বড় অংশ খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে কঠোরভাবে অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলছেন, বিগত দিনে দলের পদ দখলে রাখা এসব নেতারা কোন আন্দোলন সংগ্রাম তৈরি করতে পারেননি। নেতাকর্মীকেও ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেনি যে কারণে সরকারের বিরুদ্ধে কোন ইস্যু দাঁড় করাতে পারেননি। তারা বলছেন, বিএনপির কিছু প্রভাবশালী নেতা ভেতরে ভেতরে সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। সরকারের সঙ্গে হাত মেলানো এসব নেতাদের কার্যকলাপে সাধারণ মানুষ এখন বিএনপির প্রতি বিরক্ত। তারা এখন বিএনপি প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। এই অবস্থায় বিএনপির কোনোভাবেই উচিত হবে না দলীয় চেয়ারপারসনকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাওয়া।
তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেবে কি নেবে না তা নির্ভর করছে দলটির নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শী সিদ্বান্তের ওপর। বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করে বলছেন, দলটি যদি ভুল নির্দেশনায় চালিত হয়ে দশম জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারও আত্মঘাতি পথে হাঁটে তাহলে এর সুফল ভোগ করবে তৃতীয় কোন পক্ষ। এখন দেখার বিষয় বিএনপি কি তৃতীয় পক্ষকে সেই সুযোগটা দেবে!