প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তোরণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এবং ক্ষুধাও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ প্রতিষ্ঠা করতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সফল পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গ্রাজুয়েশন লাভ করেছে, তার ধারবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন ‘এই ধারবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এবং ক্ষুধাও দারিদ্র্য মুক্ত দেশ গড়তে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সৃষ্টি করাই আমাদের লক্ষ্য’।
প্রধানমন্ত্রী দুপুরে তাঁর তেজগাঁওস্থ কার্যালয়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণ পদক-২০১৭’ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ১ম স্থান অধিকারকারী ১৬৩ জন শিক্ষার্থীর মাঝে স্বর্ণপদক বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইউজিসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন।
ইউজিসি’র সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান প্রিয়া এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সজন ধর স্বর্ণপদক প্রাপ্তদের পক্ষে নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য হিসেবে অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম এবং ড. সৌমিত্র শেখর তাঁদের রচিত ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক গ্রন্থটিও প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, মুখ্য সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক, পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ, জাতীয় অধ্যাপক বৃন্দ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, গবেষক এবং পদক প্রাপ্ত মেধাবী শিক্ষার্থীবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
দেশের উন্নয়নে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার পাশাপাশি সরকারের ধারাবাহিকতা থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘ ’৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশের যতটুকু অগ্রগতি হয়েছিল, ২০০১’র পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল তারা বাংলাদেশকে অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী আজকে যতটুকুই অর্জন করেছি, দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশ্বে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি। অর্থনৈতিকভাবে আমরা স্বাবলম্বী হয়েছি। আজকে আমরা এগিয়ে যাব। আর পিছিয়ে যাব না।’
উচ্চশিক্ষার প্রসারে তাঁর সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ও গঠন করে দিয়েছি। এখানে আমরা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা সহায়তা (বৃত্তি-উপবৃত্তি) দিতে পারছি।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি কলেজের ৩৬৪ জন শিক্ষক পিএইচ.ডি. ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড এবং সরকারি কলেজের ২২৩ জন শিক্ষক এম.ফিল ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এ ছাড়াও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩৩ জন শিক্ষক পোস্ট-ডক্টোরাল ফেলোশিপ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৬ সাল থেকে পিএইচ.ডি. ফেলোশিপ ভাতা মাসিক ১০ হাজার টাকা হতে বৃদ্ধি করে ১৫ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে এবং পোস্ট-ডক্টোরাল ফেলোশিপ ভাতা মাসিক ১৫ হাজার টাকা হতে বৃদ্ধি করে ২০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
বর্তমানে ৮৪টি পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও গবেষকগণ ইউজিসি ডিজিটাল লাইব্রেরির মাধ্যমে বিশ্বের ১৩টি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রকাশকের ৩৪ হাজারেরও অধিক ই-রিসোর্স এক্সেস সুবিধা পাচ্ছেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
সরকার প্রধান বলেন, শিক্ষার মান উন্নয়নে আমরা ২০১০ সালে ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ পাস করেছি। বর্তমানে দেশে ৪৬টি পাবলিক ও ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৪৯টি।
তিনি বলেন, আমরা উচ্চশিক্ষার প্রসারে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ৬টি এবং ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৩টি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি।
এর মধ্যে -৪টি নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ৯টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি-আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিজিএমইএ ফ্যাশন ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিভিন্ন বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
পর্যায়ক্রমে দেশের সকল বিভাগে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তাঁর সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরাই প্রথম দেশে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করি। সম্প্রতি রাজশাহী ও চট্টগ্রামে নতুন দু’টি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া সিলেটে আরও একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে ‘অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল আইন’ পাস হয়েছে এবং শীঘ্রই এর কার্যক্রম শুরু হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানসমৃদ্ধ করা এবং তাদের তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য ‘উচ্চশিক্ষা কমিশন’ প্রতিষ্ঠার কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তাঁর সরকার গবেষণাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে একে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা মেধাবী তাদের মেধা ও মননের বিকাশে আমাদের সুযোগ করে দিতে হবে ।’
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুণর্গঠণকালেই উচ্চশিক্ষার বিকাশে জাতির পিতার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন প্রতিষ্ঠা, কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন সহ বিভিন্ন পদক্ষেপও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে স্বর্ণপদক জয়ী মেধাবীদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে দেশ ও জাতিকে তোমরা যথাযথ ও সঠিক নেতৃত্ব দিবে। তোমাদের মেধা, জ্ঞান ও কর্মের ফলে দেশের উন্নয়নে অধিক গতি সঞ্চারিত হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই ছেলে-মেয়েরাই আগামীতে দেশের কর্ণধার হবে। এরাইতো আমাদের মত মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ের সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন খাতে কাজ করবে।
তিনি এ সময় ১৬৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৬২ জন ছেলে শিক্ষার্থী হওয়ায় এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ছেলেদের ফল আশানুরুপ না হওয়ায় মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেদের ও অধিকহারে পাঠে মনোনিবেশের আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় আমাদের দেশে মেয়েরা সত্যই অবহেলিত ছিল। বাবা-মা, অভিভাবক মনে করতেন মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে কি হবে, দু’দিন পরে বিয়ে দিতে হবে। বিয়ের খরচ আছে। লেখাপড়া শিখেতো পরের ঘরেই চলে যাবে। এই মানসিকতার যে পরিবর্তন হয়েছে সেটাই সবথেকে বড় কথা।
জাতির পিতা বলেছিলেন সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার ছেলে চাই উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, জাতির পিতা ছেলে-মেয়ে উভয়ের কথাই এখানে বলেছিলেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু তাঁদের ব্যক্তিগত লেখাপড়ার বিষয়টাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে আগত কৃতি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে এ সময় বলেন,‘সেই সোনার ছেলে-মেয়েই এখানে উপস্থিত।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর নেতৃত্বে দেশের আথর্-সামাজিক উন্নয়নের খন্ডচিত্র তুলে ধরে ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত- সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকারও এ সময় পুণর্ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও প্রহণ করেছি। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। এখন ২০২১ সাল থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা কিভাবে দেখতে চাই, কেমন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই-সেই পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ ইতোমধ্যে আমরা শুরু করেছি।
তিনি বলেন, একটি মানুষও গৃহহারা থাকবেনা, কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না, কেউ অশিক্ষার অন্ধকারে থাকবে না। প্রতিটি গ্রাম হবে শহর। শহরের সব নাগরিক সুবিধা গ্রামের মানুষ পাবে, প্রত্যেকটি অঞ্চল উন্নত হবে-সেভাবেই দেশকে গড়ে তুলবো। সেই পরিকল্পনা নিয়েই আমরা কাজ করে যাচিছ।