অতীত কখনো মরে না; ১৫ আগস্টের দীর্ঘ ছায়া : লরেন্স লিফশুলৎজ

পচাত্তরের পনেরোই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের উপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনারের একটি বাণীকে সবচেয়ে বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেটি হল, অতীত কখনোই একেবারে মরে যায় না, এমনকি অতীতটাকে অতীতও বলা যায় না। আমাদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সত্তরের দশজুড়ে জীবিত ছিলাম, আমরা জানি এই তারিখটি একটি যুগের জন্যে মাইলফলক হয়ে থাকবে। আমরা এমন এক গন্তব্য পাড়ি দিয়েছি, তারা ছিলেন সেটার পথ নির্দেশক। অবশ্য অনেকেই সেই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি।

পনেরো আগস্ট রাতের সেই নৃশংস ও বিভৎস হত্যাকা-ের দায় বাংলাদেশকে এতগুলো বছর পরেও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। একাত্তরের মার্চের কালো রাতের পর চারটি বছরও পার হতে দিল না, এরইমধ্যে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর প্রথাগত অভ্যুত্থানের ন্যাক্কারজনক ঐতিহ্যেরই পুনরাবৃত্তি ঘটালেন নতুন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ছোট একটি দল। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে জাতীয় নির্বাচনের ফল মেনে না নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক ও সশস্ত্র সামরিক যান নামিয়ে গণহত্যায় মেতে উঠেছিল। যদিও নির্বাচনের ফল পাকিস্তান সরকারের মেনে নেয়ার কথা ছিল।

universel cardiac hospital

অভ্যুত্থানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলেন। অথচ এই মহান নেতার নামেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এরপর বিপদগামী এই সেনা দলটি একের পর এক উন্মক্ত হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। স্ত্রী, বারো বছরের শিশুসন্তানসহ শেখ মুজিবের প্রায় পুরো পরিবার এই নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হলেন। সেই বিভৎস রাতে মুজিব পরিবারের আত্মীয়দের হত্যা করতে সেনা সদস্যের একটি পক্ষ শহরজুড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায়।

স্বামীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে তাঁর এক আত্মীয়ের গর্ভবতী স্ত্রী নিহত হলেন। দেশের বাইরে থাকা মুজিবের দুই মেয়েই কেবল জীবিত রইলেন। তাদের মধ্যে শেখ হাসিনা পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন (বর্তমানে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন)। কয়েক বছর আগে তিনিও বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালে দিনের আলোয় গুপ্তঘাতকের হামলার শিকার হয়েছিলেন। অল্পের জন্যে জীবনে রক্ষা পেলেন। ফকনারের সেই বিখ্যাত উক্তি আবারো মনে পড়ে, এমনকি অতীতকেও অতীত বলা যাবে না, দেখা যাচ্ছে এখানে অতীত খুব বেশি-ই বর্তমান হয়ে আছে।

এ সময়ের রাজনৈতিক হিসেব নিকেষও সেই পচাত্তরের পনেরোই আগস্টের বিভৎস ঘটনারই পরম্পরা মাত্র। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রয়াত জেনালের জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। পচাত্তর সালে জিয়া সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান ছিলেন। সেই সময়ের সামরিক অভ্যুত্থান ও পরবর্তী নির্মম ঘটনার নেপথ্যে তিনিও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
সেই রাতে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অপ্রকাশিত ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সে দিনগুলোতে দূতাবাসের এক লোক যিনি এই অভ্যুত্থান পর্যবেক্ষণ করছিলেন, যদিও তার কাছেও ঘটনা পুরোপুরি স্পষ্ট ছিল না। তার পেটে একটি ছোট জট বেধে যায়। কারণ তিনি এতদিন যে ঘটনাগুলো ঘটবে বলে ভয় পাচ্ছিলেন এবং যা ঠেকাতে ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছেন, তাই ঘটে গিয়েছে।

বছর তিনেক পরে ওয়াশিংটনে আমি এই লোকের সাথে দেখা পাই। পরবর্তীতে তিনি আমার কাছে খবরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়েছিলেন। তিনি যেসব তথ্য আমাকে দেন, সেগুলো একদিন তিক্ত ও অস্বস্তিকর সত্য হয়ে দেখা দেবে বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম। এই সত্যই এক সময়ে জবাবদিহিতা তৈরি করবে। গেলো ত্রিশ বছরে প্রথমবারের মতো এই স্বতন্ত্র বিষয়টি শনাক্ত করতে পারি। এভাবে গোপনীয়তা রক্ষার কঠোর চাপ থেকে আমি মুক্ত হয়েছি। কিন্তু যখন আমি কিভাবে ও কেন এই স্বতন্ত্র বিষয়টির মুখোমুখি হলাম, সেই ঘটনার ব্যাখ্যা দেব, তখন অবশ্যই কিছুটা ধৈর্য আপনাকে ধরতে হবে।
অভ্যুত্থানের প্রতিবেদন তৈরি করতে বহু বিদেশি সাংবাদিকদের একজন হিসেবে আমিও ঢাকায় ছিলাম। আমিই একমাত্র সাংবাদিক যিনি এই বহুল ঘটনাগুলোর প্রতিবেদন বড় ধরনের প্রকাশনায় লিখেছি। একজন সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে বসবাস করেছি। চুয়াত্তর সালে আমি হংকংভিত্তিক ফার ইস্টার্ন ইকোনোমিক রিভিউ পত্রিকার ঢাকা প্রতিনিধি ছিলাম। সেই বছরগুলোতে আমি নয়াদিল্লিতে গিয়েছি ও পত্রিকার দক্ষিণ এশীয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনও করেছি। কিন্তু শেখ মুজিবের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনার পর আমি এ ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধানে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ি। অথচ আমি আগে কখনোই ভাবিনি যে আমাকে এমন কাজ করতে হবে। এমনকি নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলার আগে বিষয়টি নিয়ে বহুবার ভেবেছি।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে কর্মরত সেই লোকটি আমাকে সাহস দিলেন। সততা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিলেন। যদিও তিনি আমার নিয়মিত সংবাদ সোর্স না। তিনি ছিলেন সেই সব ব্যতিক্রমি লোকদের একজন যাদের আমলাতান্ত্রিক চরিত্র ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত প্রকাশ পেয়ে থাকে। তিনি সেনা অভ্যুত্থান ও পরবর্তী হত্যাকা-ের ঘটনায় মর্মবেদনায় ভুগছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন একজন বিবেকবান লোক। ঠিক আমাদের মতো না, তিনি এমন কিছু জানতেন, যেটা অন্য কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। তার এই জ্ঞানই তাঁর বোধ তৈরি করেছে। এটা ছিল নৈতিক দায়িত্বশীলতার বোধ, এতে করে আমরা পরস্পর দেখা করেছি। একজন তরুণ প্রতিবেদক হিসেবে যা ছিল আমার কাছে খুবই স্মরণীয় ঘটনা।

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পর কর্মকর্তারা গুজব ছড়ায় এবং রাষ্ট্রের দাসানুদাসরা আমাকে নানাভাবে বিরক্ত করে। তবে এ অবস্থাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের মধ্যে হানাহানি শুরু হয়। ঘটনাগুলোর যে ভাষ্য তখন তৈরি হয়েছিল, তা ছিল এমন যে তিনশ’ লোকের সঙ্গে ছয় অধস্তন কর্মকর্তা তাদের কমান্ডের অধীনে বঙ্গবন্ধুকে উৎখাত করতে বিদ্রোহ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কিছু কর্মকর্তার ব্যক্তিগত বিদ্বেষ চরিতার্থ করতেই এই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। ঘটনার পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, কয়েক বছর বা তারও বেশি সময় ধরে নেয়া পরিকল্পনা মোতাবেক এই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। বরং এটা ছিল তাৎক্ষণিক নেয়া কোন সিদ্ধান্ত।

যেদিন সকালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল, সেদিন সকালেই তরুণ মেজররা খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে। সাধারণত আওয়ামী লীগের ডানপন্থী ঘরানার লোক হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হত। মজার ব্যাপার হল, এই অভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার ঘটনায় নিজের ভূমিকার ব্যাপারে খন্দকার মোশতাক নিখুঁতভাবে বাক সংযম ছিলেন। এই বেদনাদায়ক ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন কিনা; তা স্বীকার কিংবা অস্বীকার কোনটাই করেননি। এই প্রশ্নে তিনি সব ধরনের জনসম্মুখের আলোচনা এড়িয়ে চলেছেন। তিনি নিজের ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করতেই বেপরোয়া ছিলেন।

অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার বছরখানেক পর, এরমধ্যে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন। এরপর দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার আগে খন্দকার মোশতাক তার ঢাকার বাসায় এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেন, অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি আগে থেকে কিছুই জানতেন না অথবা সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানকারী মেজরদের সাথে তার কোন বৈঠকও হয়নি। যাইহোক, সেনা অভ্যুত্থানে যে সব মেজররা অংশ নিয়েছিলেন ও পাল্টা অভ্যুত্থানে মাত্র চার মাসের মধ্যে যারা নির্বাসিত হয়েছিলেন, তারা ভিন্ন কাহিনী বলা শুরু করলেন।

ব্যাংকক ও অন্যত্র সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে সেনাবাহিনীর এ সব মেজররা আগের পৃষ্ঠপোষক ও জোট থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের প্রবণতার বাইরে গিয়ে কথা বলা শুরু করে। এ সময়ে অভ্যুত্থানের আগে মোশতাক ও তার সহযোগীদের সাথে বৈঠকের বিষয়টি তারা নিশ্চিত করে। এভাবেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে শুরু করে। মোশতাক ও তার রাজনৈতিক সহযোগীরা বছরখানেক আগে থেকে অভ্যুত্থানের গোপন পরিকল্পনার সাথে জড়িয়ে পড়ে।

অভ্যুত্থানের মাসকয়েক পরে আমেরিকান দূতাবাসের মাঝারি পর্যায়ের এক কর্মকর্তা আমাকে বলেন, আগস্টের ঘটনাবলি নিয়ে দূতাবাসের মধ্যে খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি বলেন, দূতাবাসের মধ্যে বিভিন্ন গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল। যেমন, সিআইয়ের কর্মকর্তা ফিলিপ চেরি যেভাবেই হোক এই অভ্যুত্থানে জড়িত ছিলেন। চেরি ও আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ইউজেন বোস্টারের মধ্যে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট হতাশা ও দুঃশ্চিন্তা কাজ করছিল। তবে এই উত্তেজনার ধরন নিয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি। কেবল জানিয়েছেন, এতে বিস্তর সমস্যা ও জটিলতা আছে। তিনি বলেন, আমি বুঝেছি, এমনকিছু ঘটেছে, যেটা ঘটা উচিত ছিল না। তিনি বিষয়টির আরও অতলে যেতে আমাকে তাড়া দেন।

অভ্যুত্থানে আমেরিকার অংশগ্রহণ নিয়ে আমার মাথায় আলাদা কোন ভাবনা কাজ করেনি। দেশটির কংগ্রেসের দুটি কমিটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) অবৈধ গোপন অভিযান নিয়ে তদন্ত চালিয়েছিল। বিদেশী নেতাদের সিআইয়ের গুপ্তহত্যার বিষয়ে ওয়াশিংটনের তথাকথিত গির্জা ও পাইক কমিটিতে শুনানি হয়েছিল। আমেরিকার কূটনৈতিক ও গোয়েন্দাদের মধ্যে ¯œায়ুচাপ ও উত্তেজনা তৈরি হয়। দেশটির গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে ধারণা করা হয়েছিল যে চিলিসহ অন্যান্য দেশে গোপন অভিযান পরিচালনার দায়ে আমেরিকার জ্যেষ্ঠ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা কারাদ- ভোগ করতে যাচ্ছে।

সময়টা ছিল গরমে হাপিয়ে ওঠার। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রথম কিছু সংক্ষিপ্ত নাম শুনতে পেল। যেমন, মোনগুস (MONGOOSE), কোইনটেলপ্রো (COINTELPRO), এএম/এলএএসএইচ (AM/LASH)। এগুলো ব্যাখ্যা করে তারা কঙ্গোর লুমামবা, কিউবার ফিদেল কাস্ট্রো ও চিলির এ্যালেন্ডের মতো রাষ্ট্রনেতাদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারেন। আমেরিকান ষড়যন্ত্রের গোপন হাত বহু দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়। আমেরিকানরা প্রথমবারের মতো যখন পরিস্কারভাবে ভাবতে শুরু করে, তখন দেশটির গোয়েন্দাদের এসব ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেতে শুরু করে।

ভারতের ইন্দ্রিরা গান্ধিও বঙ্গবন্ধু হত্যার বেদনাদায়ক ঘটনা নিয়ে কথা বলেছেন। এই হত্যাকা-ে বিদেশি ইন্ধন ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। তবে তার কাছে সুষ্পষ্ট তথ্যের অভাব ছিল। এমনকি ভারতে জরুরি অবস্থার প্রাথমিক দিনগুলোতে ইন্দ্রিরার অন্যতম সমর্থক মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার (সিপিআই) বিষয়টি ছিল অত্যন্ত সুষ্পষ্ট। সিআইএ বলেছে, সিপিআই এই অভ্যুত্থানের নেপথ্যে ছিল। যদিও কোন তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এক ধরনের প্রচারণা হিসেবে আমি এটি মাথা থেকে খারিজ করে দিয়েছে।

লেখক: ফার ইস্ট ইকনমিক রিভিউ (হংকং), গার্ডিয়ান (লন্ডন), লা মদ (ফ্রান্স), দা নেশন (নিউইয়র্ক) ও বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকার সাবেক সাংবাদিক। ভাষান্তর: আতাউর রহমান রাইহান

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে