১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ঘাপটি মেরে থাকা দালালদের সহযোগিতায় একদল বিপথগামী সেনা সদস্য ইতিহাসের জঘন্যতম ও বর্বরোচিত এক হত্যাকান্ড ঘটায়। সেই হত্যাকান্ডে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে জাতির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছিল যে নরাধম ঘাতকরা, তাদের ৬ জন এখনো পলাতক রয়েছে বিভিন্ন দেশে।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে সমর্থ হয়। তারপর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারকার্য শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। হত্যাকান্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় ২৩ জনকে আসামি করে মামলা করেন। তদন্ত শেষে পুলিশ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দিলে ওই বছরেরই ১২ মার্চ ঢাকায় দায়রা জজ আদালতে শুরু হয় বিচার।
একই বছরের ৭ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট আদালত ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এক্ষেত্রে মৃত্যু হওয়ায় আসামির তালিকা থেকে বাদ পড়েন মোশতাক আহমেদ, মাহবুবুল আলম চাষী ও মোস্তফা আহমেদ। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার দায়রা জজ গোলাম রসুল ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন।
আসামিপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন এবং আসামিপক্ষের আপিলের প্রেক্ষিতে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভক্ত রায় দেয়। দ্বিধাবিভক্ত রায়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখলেও অপর বিচারপতি মোঃ রুহুল আমিন ১০ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন।
হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল ১২ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে অপর ৩ জনকে খালাস দেন। তৃতীয় বিচারপতির রায়ের বিরুদ্ধে ৫ আসামি আপিল দায়ের করলেও ২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়।
পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় দেয়া রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত কারাবন্দী ৫ আসামির দায়ের করা পিটিশন খারিজ করে দেয় সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগ।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট ২৯ কার্যদিবস হাইকোর্টের রায়ের পেপারবুক পঠন, শ্রবণ এবং আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের সওয়াল-জবাব শোনার পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের নিষ্ফল প্রাণভিক্ষা শেষে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি আসে সেই শুভলগ্ন। রাত ১২টার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ১২ আসামির মধ্যে ৫ জনের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় গ্লানির দায়মুক্তি ঘটে।
অবশ্য এই দায়মুক্তির জন্য জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৩৪ বছর। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা তালিকায় ছিল- কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান।
তাদের পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হলেও বাকিদের এখনো শাস্তি দিতে সক্ষম হয়নি বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী ছয় ঘাতক এখনো পলাতক রয়েছে বিভিন্ন দেশে। অবশ্য খুনি আজিজ পাশার ইতোমধ্যে বিদেশে পলাতক অবস্থায়ই মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু খুনি আবদুর রশিদ, শরীফুল হক ডালিম, রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, মোসলেহউদ্দিন খান ও আবদুল মাজেদ এখনো পলাতক।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, নূর চৌধুরী কানাডায় পালিয়ে আছে অনেক বছর ধরে। আরেক খুনি মোসলেহউদ্দিন খান রয়েছে জার্মানিতে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়- রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, আবদুর রশিদ পাকিস্তান বা লিবিয়ায়, শরীফুল হক ডালিম পাকিস্তানে এবং আবদুল মাজেদ সেনেগালে পালিয়ে রয়েছে।
অবশ্য সম্প্রতি একটা খবর এসেছে পত্রপত্রিকায় যে, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ডেইলি কলার’ এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
সোমবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে পারেন। রাশেদ চৌধুরী ১৯৯৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে আসছেন। সেখানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন।
খবরে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে, মার্কিন সরকার একজন রাজনৈতিক আততায়ীকে আশ্রয় দিয়েছে। ২০১৪ সালে ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন লিখেছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত একজন খুনি রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছেন। এ অবিচারের অবসান ঘটতে হবে। রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সময় হয়েছে।
পলাতক খুনিদের জন্য ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করা আছে। তবে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা। যেদিন এই পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হবে- সেদিনই আমাদের সর্বোচ্চ কূটনৈতিক সাফল্য প্রমাণিত হবে বলে মনে করি।