বড় একটা শক্তি তিনি : ফজলুর রহমান

বাঙালির একটা বড় শক্তির নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্থপতি তিনি। বিশাল হৃদয়ের মানুষ তিনি। গড়পরতা বাঙালির চেয়ে উচ্চতায় অনেক অনেক বড় তিনি। জানা ইতিহাসে বাঙালি কখনোই স্বাধীন ছিল না। সেই চির পরাধীন জাতিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, এবং সেই স্বাধীনতা অর্জন করে দেখিয়েছেন।

এসব কথা, বহুবার, বহুভাবে লেখা হয়েছে। বলা হয়েছে, বলা হচ্ছে। ঘরে-বাইরে দেশে বিদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রতিদিন আলোচনা, কথার শেষ নেই। তার জীবন, তার রাজনীতি, তার সংগ্রাম, তাকে ঘিরে ষড়যন্ত্র এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা, এসব কিছু নিয়ে দুনিয়াজুড়ে গবেষণা হচ্ছে। হতেই থাকবে। এসবের বাইরে বঙ্গবন্ধুর নিজের একটা উপলদ্ধির কথা স্মরণ করা যেতে পারে সবার আগে। ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ মানুষকে ভালোবাসার এই শক্তিটা তিনি পেয়েছিলেন জীবন থেকে। ছাত্রজীবন থেকে রাজনৈতিক জীবন তারপর রাষ্ট্রনায়কের জীবন, তিনি কখনোই মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হননি। মানুষের ওপর আস্থা হারাননি। জীবনের শেষ দৃশ্যেও তিনি অটল থেকেছেন এই ভালোবাসায়। যদি তাই না হতো, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু হতে পারতো অন্যভাবে।
১. তিনি খুনিদের দেখে ভয়ে থর থর করে কাঁপতে পারতেন।
২. তিনি পরিস্থিতি দেখে ভয়ে লুকোতে চেষ্টা করতেন।
৩. তিনি পালানোর চেষ্টা করতে পারতেন।
৪. তিনি জীবন ভিক্ষা চাইতে পারতেন।

universel cardiac hospital

না, তিনি এসব করেননি। মানুষের জন্য। দেশের জন্য দেশের মানুষের ভালোবাসার জন্য তিনি মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করেছেন। বলা হয় তিনিই মহান বীর যিনি মৃত্যু দৃশ্যেও অটল থাকতে পারেন। আর কিছু নয় বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদৃশ্যটা ভাবলেই স্থির বোঝা যায় তিনি কতবড় নিঃশঙ্ক চিত্তের মানুষ ছিলেন। সামনে খুনিরা দাঁড়িয়ে। তিনি সেই খুনিদের ধকম দিচ্ছেন। ধকম দিচ্ছেন মৃত্যুকে। তার হুঙ্কারে খুনিরা থরথর কেঁপে ছিল প্রথম দিকে।

প্রশ্ন হচ্ছে রাজধানী ঢাকা থেকে অনেক দূরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া একটি মানুষ এতো ‘শক্তিধর’ সাহসী হয়ে উঠলেন কীভাবে? ওই যে মানুষের ভালোবাসা। তিনি মানুষকে ভালোবাসা দিয়েছেন। মানুষও তাকে ভালোবেসেছেন অকৃপণ। ‘বামনের দেশে মহীরুহ তিনি’- এমন একটা কথা লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের বড় প-িত হুমায়ুন আজাদ। ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’ বইয়ে হুমায়ুন আজাদ বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করেছেন একেবারে নিজের ভূমিতে দাঁড়িয়ে।

দুই.
একজন রাজনীতিবিদ, একজন সংগ্রামী, একজন মুক্তিকামী মানুষ বলছেন- ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ তাহলে তাকে, তার জাতিকে রুখতে পারে; এমন সাধ্য কার? তারপর সেই অমরকাব্য-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এর আগে বাঙালি এমন কথা শুনেনি। এমন ডাক পায়নি। বঙ্গবন্ধু বলছেন, মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে।’

মানুষের এই ভালোবাসার প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। যদি কেউ স্মরণ করে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের সেই দৃশ্য। সেখানে জনতাই একজন মানুষকে মহানায়ক বানিয়ে দিলেন। বাঙালির প্রথম সত্যিকারের মহানায়ক। সেদিন মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছিলো। এ ভালোবাসার এক অমোঘ টান। এই ভালোবাসা বঙ্গবন্ধু অর্জন করেছিলেন মানুষের পথে হেঁটে হেঁটে। তিনি মানুষের জন্য, বাঙালির জন্য নিজেকে কীভাবে তৈরি করেছিলেন তার একটি জীবন্ত দলিল ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। আগামীতে যারা রাজনীতি করতে আসবেন, যারা দেশ চালাবেন, যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হবেন তাদের জন্য অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত শেখ মুবিজুর রহমানের লেখা ওই গ্রন্থটি। কেনো না, বঙ্গবন্ধু বিশ^াস করতেন; বলতেন ‘প্রধানমন্ত্রী হবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু, যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছেন, তা আমি সারাজীবন মনে রাখবো।’ এদেশ, এদেশের মানুষ, মাটির প্রতি তার দরদ ছিল আকাশস্পর্শী। তিনি এটা বলতেন এবং গভীরভাবে অনুধাবন করতে। ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।’

এক্ষণে উদ্ধৃত করা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুর আরো কিছু চিন্তা, উপলদ্ধি।
১. এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু এই লাখো শহীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে।
২. দেশ থেকে সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার ও শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য দরকার হলে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব।
৩. আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারব না।
৪. এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে, তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।
৫. আমাদের চাষীরা হল সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণি এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে।
৬. জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাবে না। তবে কোনো আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন?
৭. দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
৮. জনগণকে ছাড়া, জনগণকে সংঘবদ্ধ না করে, জনগণকে আন্দোলনমুখী না করে এবং পরিষ্কার আদর্শ সামনে না রেখে কোনোরকম গণআন্দোলন হতে পারে না।
৯. গণআন্দোলন ছাড়া, গণবিপ্লব ছাড়া বিপ্লব হয় না।
১০. আন্দোলন মুখ দিয়ে বললেই করা যায় না। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হয়। আন্দোলনের জন্য আদর্শ থাকতে হয়। আন্দোলনের জন্য নিঃস্বার্থ কর্মী হতে হয়। ত্যাগী মানুষ থাকা দরকার। আর সর্বোপরি জনগণের সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকা দরকার।
১১. অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোন দিন একসাথে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।
১২. আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।
১৩. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে ।
১৪. বাঙালি জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

এই হলেন বঙ্গবন্ধু। এই হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই বলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। এই হলেন বিশ^ নেতা যিনি ভবিষ্যত দেখতে পেতেন। নিজের ভেতর দেখতে পেতেন একটি জাতির স্বপ্নকে। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখেছেন। সেই স্বপ্ন জাতিকে দেখিয়েছেন। এবং সেই স্বপ্নের পথ ধরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করে দেখিয়েছেন। তার এই স্বপ্নে, সংগ্রামে মূল শক্তিটাই ছিল বাংলার জনগণ। তিনি বার বার সেই কথাই বলেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা কেবল একটি হত্যাকা- নয়, একটি জাতিকে অভিভাবকহারা করে ফেলা। একটি আদর্শকে হত্যা করা। একটি দর্শনকে স্তব্ধ করে দেয়া। যতদিন যাচ্ছে, বাংলাদেশকে যতবার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিপৎসীমার কাছাকাছি, ততবাই মনে হচ্ছে বাঙালির জন্য, এদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু নামের শক্তিটার বড় বেশি প্রয়োজন ছিলো।

লেখক: সাংবাদিক

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে