১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য প্রসঙ্গ : র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির নেতা, বাঙলার নেতা, বাঙলার মানুষের নেতা। ক্ষমতার উচ্চ মার্গ থেকে নেতা হয়ে নাজিল হননি। মাটির কাছকাছি থেকে আন্দোলন সংগ্রামের দুর্গম পথ বেয়ে মানুষের আশা আকাঙ্খাকে ধারণ করে ক্ষমতার উচ্চ মার্গে আরোহন করেছিলেন। বন্ধুর কন্টকাকীর্ণ এই পথ পাড়ি দিতে অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে তাঁকে। মানুষের প্রতি তাঁর অম্লান ভালবাসা আর লক্ষ্যের প্রতি স্থির ও অবিচল আস্থা তাঁকে এই পথ অতিক্রমনে পাথেয় হিসেবে সহায়তা করেছে। তিনি কখনো লক্ষ্যচ্যুত হননি এবং জনতার ওপর থেকে আস্থা হারাননি। তাঁর ভাষায় : জনগণের ভালবাসা হচ্ছে শক্তি এবং জনগণকে অতি ভালবাসা হচ্ছে তাঁর দুর্বলতা।

বিশ্বাসঘাতকতার ছুরি তাঁর পথ চলাকে থমকে দিয়েছে সত্য, আদর্শের অগ্নিশিখা আজও তাঁর পথ অনুসরণে লক্ষকোটি মানুষের পথচলার প্রেরণা হয়ে কাজ করছে। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সুখী সমৃদ্ধশালী উন্নত বাংলাদেশ ছিল তাঁর স্বপ্নের সাধ যার নাম দিয়েছিলেন তিনি ‘সোনার বাংলা’। রবীন্দ্র অন্তঃপ্রাণ এই মানুষটি ’ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’’ এই আপ্তবাক্যকে সম্বল করে জীবনের পথে হেঁটেছেন। একটি অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র পরতে পরতে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পথ চলার শুরুর কাহিনী এই ভাবেই বর্ণনা করেছেন অনাগত ভবিষ্যতের মানুষের জন্য।

এই মহান মানুষটিকে ১৫ আগস্টে যখন হত্যা করা হয় তখন ঘটনার আকস্মিকতায় সারাদেশ বাকরুদ্ধ। আমরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নেতার বিশ্ববিদ্যালয় আগমন উপলক্ষ্যে ব্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে তিনি যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন, সেদিনই প্রতুষ্যে তাঁকে সপরিবারে (প্রবাসে থাকার কারণে দুকন্যা বেঁচে যান) হত্যা করা হয়। আজকের বাস্তবতায় অনেকেই বলেন সেদিন যে রকম প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ হওয়া দরকার ছিল তা হয়নি।

তবে এ কথা সত্য যে, হত্যার পর পরই যে ভাবে প্রতিরোধ গড়ে উঠার প্রয়োজন ছিল, আওয়ামীলীগের তথা তদানিন্তন বাকশালের প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে তা হয়ে উঠেনি। কিন্তু আকস্মিকতার ধাক্কা সামলিয়ে উঠে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাকশালের কমিউনিস্ট পার্টি অংশের প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্ব, আওয়ামীলীগ অংশের স্বল্প সংখ্যক দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর নেতৃত্ব, যুবলীগের প্রথম শ্রেণীর কয়েকজন নেতা, ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম শ্রেণীর প্রায় সকল নেতা সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও প্রতিরোধের পথে অগ্রসর হতে সক্ষম হন। এ লক্ষে বাকশালের নেতৃবৃন্দ এবং জাতীয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে সংযোগ ও যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। বাকশালের অঙ্গ সংগঠন জাতীয় যুবলীগের কতিপয় প্রথম শ্রেণীর নেতা, জাতীয় ছাত্রলীগের নেতৃত্বের সাথে মিলে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ও পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস নেন।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সাবেক সদস্য ও তদানিন্তন জাতীয় ছাত্রলীগের অন্যতম সদস্য জনাব নূহ-উল-আলম লেলিন ও খ্যাতিমান সাংবাদিক, তদানিন্তন জাতীয় ছাত্রলীগের অন্যতম সদস্য জনাব অজয় দাশগুপ্ত তাদের গ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- : প্রতিবাদের প্রথম বছর’ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা সারাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম ছাত্র মিছিল সম্পর্কে বলেন- ‘প্রথম দিনের মিছিলের সাফল্যে আমরা সকলেই উৎসাহিত হই। এই কর্মসূচি ক্যাম্পাসের ভেতর ও বাইরে আমাদের কর্মী সদস্যদের চাঙ্গা করে তোলে। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর প্রতিবাদী হয়ে না উঠতে পারার গ্লানি ও যন্ত্রণার কিছুটা লাঘব হয় এতে।

২১ অক্টোবর সকাল দশটার দিকেই ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী-সমর্থকেরা (জাতীয় ছাত্রলীগের কর্মীগণ- নিবন্ধকার) মধূর ক্যান্টিনে জমায়েত হতে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ( যেমন জগন্নাথ ও ঢাকা কলেজ- নিবন্ধকার) তাদের উপস্থিতি ছিল উৎসাহজনক।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ছাত্রলীগের দু’একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আমাদের এ আন্দোলন রচনার নেপথ্যে থাকলেও সুদীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রকাশ্যে আসতে সাহস করেননি। এ সময়ে যুবলীগের এস.এম.ইউসুফ, শফিকুল আজিজ মুকুল, ফকির আব্দুর রাজ্জাক, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু যথেষ্ট সাহসী ভূমিকা পালন করেন এবং কার্যত তারাই কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আনোয়ার চৌধুরী, শামসুদ্দিন মোল্লা, অধ্যাপক আবু সাঈদ, ডা. এস. এ. মালেক প্রমুখও সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

০২.

শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের বরপুত্র তিনি। খোকা মিয়া, মিয়া ভাই, মুজিব ভাই, শুধুই মুজিবুর। এই ভাবেই ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে একদিন তিনি এজিটেটর থেকে নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। হয়েছেন ইতিহাসের মহানায়ক, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতা। ক্ষমতার মোহ নয়, জনতার আশা-আকাক্সক্ষাই তাঁর পথ পরিক্রমণের লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য পিতার সেই আদর্শ থেকে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের পর বহু নেতৃবৃন্দ আদর্শচ্যুত হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনীতির পাশাপাশি ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও বঙ্গবন্ধু আমাদের যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন তা থেকে আমরা বিচ্যুত হইনি।

বঙ্গবন্ধুর তিরোধানের পর খুনী মোশতাক সংসদ সদস্যদের একত্রিক করে তাঁদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। তার সমর্থনে এগিয়ে যায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ওবায়দুর রহমান, আব্দুর রউফ (তিনজনই ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি) এবং রাফেয়া আক্তার ডলি। সবাই সংসদ সদস্য। মোশতাকের আহুত বৈঠকে  যোগ দেন অনেকেই এবং অনেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের নিন্দা করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিংহ হৃদয় সিরাজুল হক (বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌশুলী) মোশতাককে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারি হিসেবে বক্তব্য পেশ করলে সমর্থন আদায়ের প্রয়াস আঁতুরঘরেই মৃত্যুবরণ করে।

এ সময়ে আমরা ক’জন সংসদ সদস্যদের বৈঠক বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ধরণা দিয়েছিলাম। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবু সাঈদের ‘ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-’ গ্রন্থের উদ্বৃতি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তিনি লিখেছেনÑ ‘ছাত্র নেতৃবৃন্দ ইসমত কাদির গামা, রবিউল আলম চৌধুরী (নিবন্ধকার), মোমতাজ হোসেন, নূরুল ইসলাম, কাজী আকরাম হোসেন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বেশ তৎপর ছিলেন। তারা এমপিদের মোশতাকের বৈঠক বয়কট করার আবেদন জানান।’ (পৃষ্ঠা ১৪০)।

০৩.

জনগণের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর। স্বাধীনতার পর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বৃটিশ সাংবাদিক ডেভিট ফ্রষ্ট তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে, তাঁর শক্তির (মানসিক শক্তি) আঁধার হচ্ছে বাঙলার মানুষ এবং তাঁর দুর্বলতাও তিনি চিহ্নিত করেছিলেন এই ভাবে  I love them too much (আমি বাঙলার জনগণকে অতি মাত্রায় ভালবাসি)। এই জনগণের প্রতি ভালবাসাই আজীবন সংগ্রামী এই মহাপুরুষের রাজনীতি ও জীবনকে পরিচালিত করেছে। জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে তিনি তাঁর রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু করেছেন এবং তাঁর কর্মকাণ্ড দিয়ে তিনি জনগণের আশা- আকাঙ্খাকে নিয়ন্ত্রণও করেছেন। ভাষার জন্য আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী রাজনীতি, সামরিক স্বৈরতন্ত্র বিরোধী সংগ্রাম, বাষট্রির আন্দোলন, ৬ দফার আন্দোলন, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে পথচলা সর্বক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর সাথী হয়েছেন বাংলার জনগণ। জনগণের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতাও ছিল। তাই তিনি শোষণমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন।

তাই এক দুর্গম অজ পারাগাঁ থেকে উঠে এসে নিউইয়র্কের আলোকোজ্জল জাতিসংঘ ভবনে দাঁড়িয়ে তাঁর মায়ের ভাষা বাংলায় গর্বিত উচ্চারণে দুনিয়ার মানুষকে বাংলার সংগ্রামের ইতিহাস শোনাতে পেরেছিলেন। কিন্তু নির্মম নিষ্ঠুর ইতিহাস চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্রের ছুরি দিয়ে তাঁকে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ইতিহাসের এই দুঃসাহসী অভিযাত্রী যে হঠাৎ থমকে গেলেন, এই থমকে যাওয়ার পশ্চাৎ কাহিনী নিয়ে আদর্শের অনুসারীদের মাঝে একতরফা আলোচনা। বহুমাত্রিক অনুসন্ধান তাদের মাঝে অনুপস্থিত। তাই তো পথ চলতে বারবার হোঁচট খাওয়া।

আজকের বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু আদর্শ চিন্তা চেতনা অনেক বেশি জরুরি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রতিটি ধাপে পিতার আদর্শ ও লক্ষের ছাপ না থাকলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনের যে মৌলিক আকাক্সক্ষা তা থেকে পিছিয়ে পরব। তাই আমাদের আটপৌরে জীবনে পিতার উপস্থিতি অনিবার্য। কেননা বঙ্গবন্ধু যেমন আবহমান বাংলার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন তা এখনো বর্তমান। এবং অনাদিকাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির মধ্যস্থলে অবস্থান করবেন। তাঁর পক্ষে বিপক্ষে যাঁরাই থাকুন না কেন, তাঁকে ঘিরেই বাংলার রাজনীতি ঘূর্ণায়মান থাকবে। আমাদের মনে রাখতে হবে- মুজিব হচ্ছেন বাংলার আগামী। তাঁকে ও তাঁর আদর্শকে ধারণ করে এগুতে পারলেই আমাদের রাজনীতি জনগণের পক্ষে থাকবে। জাতীয় শোক দিবসে পিতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে