সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
কাতার ও থাইল্যান্ডকে পেছনে ফেলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এশিয়ান গেমসের দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছে গিয়েছে বাংলাদেশ। এক জয়েই ফুটবলের পেছনের সব ব্যর্থতা হয়তো মুছে যায়নি। তবে নতুন আশার গান তো শোনা যাচ্ছে! কীভাবে বদলে গেল বাংলাদেশ ফুটবল দল?
এ যেন ভোজবাজির মতো বদলে যাওয়া। যে বদলের পাওয়া যায়নি আগাম কোনো সংকেত। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়নি। আয়োজন করে খবরটা জানানোর জন্যই হয়তো এমন নীরবতা!
ক্রমাগত হার ও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে কদিন আগেও হতাশার অন্ধকারে ডুবে ছিল দেশের ফুটবল। কারা দেখাবে আশার আলো, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না এমন খেলোয়াড়। কিন্তু এশিয়ান গেমসের মতো বড় আসরে পুরো ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ। কাতার ও থাইল্যান্ডের মতো নামে-ভারে যোজন যোজন এগিয়ে থাকা দুটি দেশকে পেছনে প্রথমবারের মতো এশিয়ান গেমস ফুটবলের দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছে গেল বাংলাদেশ।
গত রবিবার কাতারকে ১-০ গোলে হারানোটা তো অবিশ্বাস্য! সবার মুখেই একই প্রশ্ন, বাংলাদেশ দলের এই বদল কীভাবে সম্ভব?
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সহকারী কোচ মাহবুব হোসেন রক্সি ইন্দোনেশিয়া থেকে ফোনে শোনালেন বদলে যাওয়া বাংলাদেশের পেছনের গল্পটা। প্রায় দু বছর ধরে বিভিন্ন মেয়াদে এই দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের সঙ্গে আছেন রক্সি। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন—
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন:
সবারই জানা নিয়মতান্ত্রিক খাদ্যাভ্যাসের অভাবে অনেক পিছিয়ে থাকে বাংলাদেশের ফুটবলাররা। কিন্তু বর্তমানে কঠোর নিয়মে বাঁধা ফুটবলারদের খাবার তালিকা। কোচ ও ট্রেনার মিলিয়ে একটি খাদ্যতালিকা তৈরি করে দিয়েছেন, এর বাইরে গিয়ে খাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চিনি, জাঙ্ক ফুড, কোমল পানীয় পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবারেরও কোনো সুযোগ নেই। ভাত খাওয়ার সুযোগ আছে যেকোনো এক বেলা, তাও পরিমাণে খুবই অল্প।
দেশকে কিছু দেওয়ার প্রতিজ্ঞা:
বর্তমান দলটি প্রায় পুরোপুরি তরুণ। দলে আসার আগে গ্যালারিতে বসে তাঁরা এত দিনে দেখে এসেছেন, সিনিয়রদের ক্রমাগত হার ও মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়া। ফলে শুরু থেকেই তাঁরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন, এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। যেকোনো মূল্যে দেশের জন্য ভালো কিছু করতে হবে। তাই কাতারের ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রাতেও দুবেলা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছে। শারীরিকভাবে নিজেদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দলীয় অনুশীলনের বাইরে ব্যক্তিগত অনুশীলনও করে থাকেন তাঁরা। পরশু ঈদ। স্বজনদের দূরে রেখে ঈদ করার কষ্ট বুকে চেপে দেশবাসীর জন্য ঈদের আগাম উপহার দেওয়ার প্রত্যয় ছিল গ্রুপ পর্বে।
হারের আগে হার নয়:
কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ মাঠে নামত কম গোল হজম করার মানসিকতা নিয়ে। কিন্তু এই দলটি মাঠে প্রতিপক্ষের নাম দেখে আগেই কাবু হয়ে নামে না। খেলার শেষ বাঁশি বাজার আগে অন্তত হারতে নারাজ।
পেছনে ফিরে গত বছর সেপ্টেম্বরে তাকান। ভারতের বিপক্ষে প্রথমার্ধে তিন গোল হজম করেও দ্বিতীয়ার্ধে চার গোল দিয়ে ম্যাচ জিতে নিয়েছিল বাংলাদেশ। সে অনূর্ধ্ব ১৮ দলের বেশির ভাগ সদস্যই আছেন এশিয়াড দলটিতে। চলতি বছর ম্যাচে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে লাওসের বিপক্ষে প্রথমার্ধে দু গোল হজম করেও দ্বিতীয়ার্ধে দু গোল পরিশোধ করে মাঠ ছাড়েন এই তরুণেরা। আর এশিয়ান গেমসের গল্পটা তো সবার সামনেই।
অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশ্রণ:
এশিয়ান গেমসে খেলে থাকে অনূর্ধ্ব ২৩ দল। যেখানে সিনিয়র কোটায় খেলতে পারেন তিনজন। অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া ছাড়াও সিনিয়র হিসেবে দলে আছেন গোলরক্ষক আশরাফুল রানা ও ডিফেন্ডার তপু বর্মণ। এই তিনজনের সঙ্গে তরুণ ফুটবলারদের সমন্বয় চোখে পড়ার মতো। বিপলু, বিশ্বনাথেরা যেমন সম্মান করে থাকেন জামালদের, তাঁরাও স্নেহের হাতে আগলে রাখেন বিপলুদের। ফলে দলীয় সংহতি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। ফুটবল আখেরে দলীয় খেলাই। একা অনেক বড় তারকাও শেষ পর্যন্ত পারে না। অথচ কাঁধ মিলিয়ে লড়লে মাঝারি মানের একটি দলও হয়ে ওঠে অবিশ্বাস্য।
পরিপূর্ণ কোচিং স্টাফ:
ইংলিশ কোচ জেমি ডের নেতৃত্বে মোট ছয়জনের কোচিং স্টাফ। জেমিসহ তিনজন ইংলিশ, বাকিরা বাংলাদেশি। মাঠ ও মাঠের বাইরে কোচিং স্টাফের মধ্যে সমন্বয়টা চমৎকার। কার কী দায়িত্ব, সব আগে থেকেই ঠিক করে রাখা। ফলে অনেক ছোট ছোট বিষয় কোচিং স্টাফের নজর এড়াতে পারে না। ভুলত্রুটি নিয়ে আবার কাজও করা হয় বিস্তর।