বিশেষ প্রতিনিধি
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নির্মূল অভিযান থেকে বাঁচতে গত বছরের আগস্ট থেকে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিসংঘ যেটাকে জাতিগত নিধনের জলন্ত উদহারণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
মিয়ানমার যদিও বলেছে, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে প্রস্তুত। কিন্তু বহু রোহিঙ্গা পরিবার নিরাপত্তার অভাবে দেশটি থেকে এখনও পালিয়ে আসছে।
গত বছরের ২৫ আগস্ট শুরু হওয়া রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের পর সংকট সমাধানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বলেই এমনটা ঘটছে।
রোহিঙ্গাদের এই ঢলে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণ নতুন করে হুমকিতে পড়েছে। দেশটির নেত্রী নোবেলজয়ী অং সান সুচির ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক রিচার্ড হোরসেই বলেন, রোহিঙ্গা সংকটে বিশ্বে মিয়ানমারের অবস্থান ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পশ্চিমা মিত্ররা একসময় সুচিকে দেশটির গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর দমনপীড়ন বন্ধে তিনি কোনো উদ্যোগ নিতে অস্বীকার করায় তাকে সমালোচিত হতে হয়েছে। তার সরকারকে সেই সঙ্গে নানামুখী চাপ সামলাতে হচ্ছে।
এমনকি রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণ ও জ্বালাওপোড়াওয়ের যেসব অভিযোগ উঠেছে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তা তিনি অস্বীকার করছেন।
বরং তিনি বাংলাদেশকে উল্টো চাপে রাখার কৌশল বেছে নিয়েছেন। মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে দেয়া এক বক্তৃতায় সুচি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন করার বিষয়টি বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করছে।
ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে পশ্চিম রাখাইনে মিয়ানমার একটি ট্রানজিট সেন্টার খুলেছে। কিন্তু হামিদা থেকে শুরু করে সম্প্রতি পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি আগস্টেই দেড়শ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন। আর এ বছরের শুরু থেকে আশ্রয় নিয়েছেন তেরো হাজার।
এতে একটা বিষয় পরিষ্কার যে আগামী শনিবার দ্বিতীয় বছরে পড়তে যাওয়া রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সুদূর পরাহতই রয়ে গেছে।
সম্প্রতি পালিয়ে আসা অর্ধডজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, শূন্য গ্রাম ও আগুনে কালো হয়ে যাওয়া বাড়িঘরের মধ্যে মাসের পর মাস জীবন সংগ্রাম চালিয়ে আসার পর তারা সেনাবাহিনীর গ্রেফতার ও হয়রানির ভয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
তারা বলেন, ঘরের ভেতরে আটকে রাখায় অনাহারে তারা মরতে বসেছিলেন। কাজের জন্য তাদের কৃষি ক্ষেতে যেতে দিত না, খাবারের জন্য বাজার কিংবা জলাশয়েও যেতে পারতেন না। এমনকি নামাজ পড়তে মসজিদে যেতেও তাদের বাধা দেয়া হতো।
মিয়ানমার দাবি করছে, তারা সংকটকে উসকে দিচ্ছে না। বরং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বৈধ অভিযান চালাচ্ছে। অথচ দক্ষিণ এশীয় দেশটি এসব সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বও কেড়ে নিয়েছে।
সুচির ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির(এনএলডি) দলের মুখপাত্র ময় নিয়ন্ট বলেন, বাঙালি লোকজনের নাগরিকত্ব পাইয়ে দিতে একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিত তৎপরতা চালাচ্ছে।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে সম্বোধন করা হয়। রোহিঙ্গা মুসলমানরা অনাহূতভাবে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রবেশে করেছেন, এমনটা বোঝাতেই তাদের বাঙালি নামে ডাকা হচ্ছে।
তেমনি পালিয়ে আসা হামিদা রয়টার্সকে বলেছেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামে এখন আলো জ্বালানোরও উপায় নেই। রাতে বাচ্চারা কাঁদলে আমি মোমবাতি পর্যন্ত জ্বালাতে পারতাম না। পুরোপুরি ব্ল্যাকআউট। আলো দেখলেই সেনাবাহিনী আসে, ধরে নিয়ে যায়।
একই ধরনের তথ্য পাওয়ার কথা বলেছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি ক্যারোলিন গ্লুকও।
নতুন আসা রোহিঙ্গাদের বরাতে তিনি বলেন, মানুষ আমাদের বলছে, তাদের সেখানে দিন কেটেছে কারাবন্দীর মত। কারফিউ এতটাই কড়া যে তারা বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি, মাছ ধরতে যেতে পারেনি। আলো জ্বালার অনুমতি ছিল কেবল নির্দিষ্ট একটা সময়।
গত সপ্তাহে ইউএনএইচসিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এখনও যারা মিয়ানমারে রয়ে গেছেন, তারাও বাংলাদেশে চলে আসার পরিকল্পনা করছেন।
হামিদা রবলেন, গতবছর অগাস্টের আগে উত্তর রাখাইনে তাদের গ্রামের জনসংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের মত। আর দুই মাস আগে যখন তিনি গ্রাম ছেড়ে আসেন, তখন পুরো এলাকা যেন বিরানভূমি; লোক ছিল মাত্র একশর মতো।
রয়টার্স লিখেছে, হামিদার বক্তব্য তারা নিজেরা যাচাই করতে পারেনি। তবে বালুখালিতে তার আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরাও একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন।
হামিদা বলেন, গতবছর যখন গ্রামের সবাই বাংলাদেশে চলে আসতে শুরু করল, তখন পথের খরচ জোগাড় করতে না পারায় তার পরিবারকে থেকে যেতে হয়। অভিযানের প্রথম ধাক্কা কেটে যাওয়ার পরও সেনাবাহিনী নিয়মিত তাদের গ্রামে টহলে যেত, কখনও কখনও রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে যেত, কাউকে আবার বিনা পারিশ্রমিকে সেনা ক্যাম্প সম্প্রসারণের কাজে শ্রম দিতে বাধ্য করা হতো।