মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন ছিলেন প্রথম স্ত্রীর প্রথম পক্ষের দুই সন্তানসহ তিনজন আর দ্বিতীয় পক্ষের সংসারে চারজন– মোট ৭ সন্তানের বাবা । সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে শেষেরজন একজন বাংলাদেশি, স্বামীর অজান্তেই যাকে ম্যাককেইনের দ্বিতীয় স্ত্রী দত্তক নিয়েছিলেন ।
১৯৯১ সালে জন ম্যাককেইনের দ্বিতীয় স্ত্রী সিন্ডি ম্যাককেইন এক মানবিক সহায়তা সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তখন ঢাকায় মাদার তেরেসার (বর্তমানে সেইন্ট তেরেসা) সঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারি পরিচালিত একটি অনাথাশ্রমে দেখা করেছিলেন তিনি।
অনাথাশ্রমে থাকা ১৬০ জন শিশুকে দেখতে গিয়ে তার চোখ পড়েছিল দুটি মেয়ে শিশুর দিকে। তাদের মধ্যে একজনের জন্মগতভাবে তালুকাটা সমস্যা ছিল। এই বাচ্চাটির অবস্থা এতটাই জটিল ছিল যে তাকে কিছুই খাওয়ানো যাচ্ছিল না। আরেকজন ছিল গুরুতর পর্যায়ের হৃদরোগী।
দু’জনেরই অবস্থাই এতটাই জটিল ছিল যে, দ্রুত উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে তাদের কাউকেই হয়তো বাঁচানো সম্ভব হতো না। এমন বাস্তবতায় সিন্ডি দু’জনকেই যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশের পাশাপাশি তাদের জন্য ভিসার আবেদন করেন।
প্রসঙ্গত, ওই সময় এমন একটা বিষয়ে অনুমতি পাওয়া ছিল খুবই কঠিন। সিন্ডি ততক্ষণ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তর্ক চালিয়ে গেছেন যতক্ষণ না তারা বাধ্য হয়ে ভিসা আবেদনে সই করতে রাজি হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে সিন্ডি বলেছিলেন, ‘ওই সময় এতটা মনোবল কোথা থেকে এসেছিল তা আমি এখনো বুঝে পাই না।’
সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে তালু কাটা অসুস্থ মেয়েটিকে দত্তক নেন সিন্ডি। নাম রাখেন ‘ব্রিজিত’। ওই সফরে সিন্ডি ম্যাককেইনের সঙ্গী ছিলেন ওয়েস গুলেট। হৃদরোগে আক্রান্ত অন্য শিশুটিকে তিনি ও তার স্ত্রী ডেবরাহ পালক নেন। তার নাম রাখেন ‘নিকি’।
অ্যারিজোনার সিনেটর জন ম্যাককেইন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিষয়ে কিছুই জানতেন না । যে কারণে বিমানবন্দরে স্ত্রীর কোলে ছোট্ট একটি বাচ্চা দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কোথায় যাচ্ছে?’ সিন্ডি জবাব দিলেন, ‘আমাদের বাড়িতে।’
ঘটনাস্থলে থাকা গুলেট এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার জনের চেহারাটা মনে আছে। তার মধ্যে যুদ্ধের বীর বা কোনো কঠোর সিনেটরের অভিব্যক্তি ছিল না। তিনি হয়ে গিয়েছিলেন আর দশজন বাবার মতোই, ভালোবাসা আর আবেগে পরিপূর্ণ।’
আর তখন থেকে নিজের মেয়ে হিসেবেই ব্রিজিতকে বড় করেছেন ম্যাককেইন দম্পতি। নিয়মিত চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠেন ব্রিজিত।
২০০০ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থিতার দৌড়ে জর্জ ডব্লিউ বুশের বিপক্ষে অংশ নেন জন ম্যাককেইন। ওই সময় এই ব্রিজিত ম্যাককেইনকে নিয়ে শুরু হয় এক রাজনৈতিক খেলা। দত্তক মেয়েকে নিয়ে ম্যাককেইন নিউ হ্যাম্পশায়ারে নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে প্রাইমারিতে জয় পেয়ে যান।
বাস্তবতা যখন এই, তখন সাউথ ক্যারোলাইনা জুড়ে ভোটারদের কাছে জরিপের নামে একটি অজ্ঞাত ফোনকল যেতে থাকে। যে ফোন কলে প্রশ্ন করা হচ্ছিল: জন ম্যাককেইনের একজন অবৈধ কৃষ্ণাঙ্গ সন্তান আছে – এমন কিছু জানার পর কি আপনি তাকে ভোট দিতে আগ্রহী হবেন?
এই স্ক্যান্ডালের ধাক্কায় সাউথ ক্যারোলাইনায় হেরে যান ম্যাককেইন। ওই নির্বাচনে আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। কিন্তু ২০০৮ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে আবারও লড়ার আশায় চেষ্টা শুরু করেন জন ম্যাককেইন। সেই সময় সিদ্ধান্ত নেন আনুষ্ঠানিকভাবে সব দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবেন।
ওই বছরের সেপ্টেম্বরে মিনেসোটায় রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ম্যাককেইন দম্পতি সবার সামনে ব্রিজিতকে নিজেদের মেয়ে হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। একই সঙ্গে প্রকাশ করেন তাকে দত্তক নেয়ার আড়ালে থাকা মানবিক ঘটনা।
ওই কনভেনশনে ব্রিজিতের পরিচয় ঘোষণার পর ৫৪ বছর বয়সী সিন্ডিকে দেখা গিয়েছিল পালিত মেয়ের হাত শক্ত করে ধরে রাখতে। একটু পর পরই চোখ মুছছিলেন দু’জনেই। সেবারও রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা নিয়ে নির্বাচনে লড়াই করেছিলেন সিনেটর জন ম্যাককেইন।