নির্বাচনে অযোগ্য হতে পারেন বিএনপির শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা!

বিশেষ প্রতিনিধি

ফাইল ছবি

বিএনপির প্রায় সব পর্যায়ের ছোট-বড় নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে বহু মামলা।এগুলো দ্রুত চলছে পরিণতির দিকে। রায়ের অপেক্ষায় আছে কোনো কোনো মামলা। কোনো কোনো মামলার বিচার প্রক্রিয়া শিগগির শেষ হবে। এসব রায়ে বিএনপির সিনিয়র অনেক নেতার ঝুঁকি রয়েছে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার।

ইতিমধ্যে কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের রায় বেরিয়েছে। সাজা হওয়ার পর আপিল করেছেন তাদের কেউ কেউ। নিম্ন আদালতের সাজা আপিলে বহাল হলে সংশ্লিষ্টদের কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

universel cardiac hospital

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারান্তরীণ রয়েছেন। সাজা হওয়ায় আগামী নির্বাচনে তার অংশগ্রহণ আপিলের রায়ের ওপর নির্ভর করছে। আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাজার রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল নিস্পত্তি করতে হাইকোর্টের প্রতি আদেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ। এর ফলে সবচেয়ে সংকটপূর্ণ সময় পার করছে দলটি।

সামনে অপেক্ষা করছে আরো সংকট। আসন্ন সেপ্টেম্বর মাসে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হলে বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, লুত্ফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাজা হতে পারে।

ইতিমধ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মশিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাজার রায় দিয়েছে নিম্ন আদালত। আগামী নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ আপিলের ওপর নির্ভর করছে। তারেক রহমানকে এক মামলায় সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে শতাধিক মামলা।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান বলেন, কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের অন্তত ২০০ নেতার বিরুদ্ধে দায়ের কিছু মামলার কার্যক্রম এতই দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে তাতে আগামী ২-৪ মাসের মধ্যে তাদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাসসহ ১৮ নেতার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে দুদক ও সরকার। উচ্চ আদালতের নির্দেশে বিএনপি নেতাদের স্থগিত মামলাগুলোতে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করতে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে তাগিদ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তাদের নির্বাচনের আগে যত বেশি সম্ভব মামলা নিস্পত্তির জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দলের সিনিয়র আইনজীবীদের মতে, বিএনপির নেতাদের মামলাসমূহ দ্রুত বিচারের জন্য যদি কোনো পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়, তবে দ্রুত চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে দলের নেতারা সহজে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। ফলে বর্তমানে সাজার ভয়ে আছেন বিএনপির শতাধিক নেতা। তার মধ্যে অন্তত ১২ জন স্থায়ী কমিটির সদস্যের মামলা রায়ের কাছাকাছি।

বিএনপির আইনজীবীরা জানান, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ আড়াই শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধেই চলছে পাঁচ হাজারের বেশি মামলার কার্যক্রম। সারাদেশে প্রায় ৭৮ হাজার মামলায় ১৫ লাখেরও বেশি বিএনপি নেতা-কর্মী আসামি বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

প্রায় সব মামলাই করা নিশ্চিত সাজা হতে পারে এমন কিছু ধারায়। হত্যা, বিস্ফোরণ, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে দ্রুত বিচার আইনের পাশাপাশি মামলা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইনে। রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের মামলাও। ব্যক্তিগত অভিযোগে দায়ের মামলার চেয়ে দলীয় মামলার সংখ্যাই বেশি। আদালতে চার্জ গঠন হচ্ছে একের পর এক মামলার। অনেক নেতা তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যাও জানেন না।

নেতাদের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীরা বলছেন, শুধু খালেদা জিয়া নয়, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র অনেক নেতার মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষের দিকে। আগামী নির্বাচনের আগে অনেকের মামলার রায় দেয়া হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। আপিল দ্রুত শেষ করে সাজা বহাল থাকলে যে কেউ নির্বাচনে অযোগ্য হতে পারেন। তাই মামলা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কা রয়েছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে সর্বমোট ৮৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৪২টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়। অন্য ৪৩টি মামলা তদন্তাধীন। সর্বশেষ গত ৬ আগস্ট রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত ও ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ তিন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একাধিক মামলা এখন বিচার প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুদকের দায়ের করা মামলাটির পুনঃতদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আপিল বিভাগও সে আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে বর্তমানে কয়েকটি মামলার বিচারকাজ চলছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মামলাও শেষ পর্যায়ে।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা একেএম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুর্নীতির মামলাগুলোর বিচার কাজ চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে। সবগুলোতেই এখন তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য-জেরা চলছে। এরপর আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য দিন ঠিক করবে আদালত।

স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, বরকতউল্লাহ বুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, শামসুজ্জামান দুদু, শওকত মাহমুদ, সেলিমা রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, মীর মো. নাছিরউদ্দিন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, জয়নুল আবদিন ফারুক, মিজানুর রহমান মিনু, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমদ, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, মজিবর রহমান সরোয়ার, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের অসংখ্য নেতার বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া এখন শেষ ধাপে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করে বলেন, আগামী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নীলনক্শা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সরকার। তারা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। এজন্য আদালতকে ব্যবহার করছে। সরকার বিএনপির নেতাদের বিভিন্ন মামলায় দ্রুত সাজা দেয়ার চেষ্টা করছে। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে সাজা দিয়ে জেলে রাখা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাত বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানের নাম না থাকলেও হীন উদ্দেশ্যে জড়িয়ে সামনে রায় ঘোষণা দিতে চাচ্ছে। শুধু তাই নয়, দলের সিনিয়র নেতাদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে যাতে বিএনপি অংশ নিতে না পারে সে জন্যই সরকার তাড়াহুড়ো করে মিথ্যা মামলায় সাজা দিতে চাচ্ছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় যে নীলনকশা হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতা চলছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে