কঠিন সময়ে বিএনপি!

বিশেষ প্রতিনিধি

ফাইল ছবি

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রতিষ্ঠার চার দশকে এসে সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। পাঁচ বছর সংসদের বাইরে থেকে নির্বাচনের বছরে এসে দলের চেয়ারপারসনের কারাবন্দী হওয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন (বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন) তারেক রহমানের দেশে না ফেরা, শীর্ষ কয়েক নেতার বিরুদ্ধে মামলার রায়, সারা দেশের নেতাকর্মীদের নামে মামলাসহ নানাবিধ কারণে গভীর বিপদে রয়েছে সাবেক সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত দলটি।

নিজেদের বিপদ মোকাবিলায় বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও দৃশ্যপটে বাস্তবিক কোনো পরিবর্তন আনতে পুরোদস্তুর ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে অনেকটা বিবৃতি-ব্রিফিংয়েই জীবিত আছে দলটি।

universel cardiac hospital

২০১৩-১৪ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেমে ব্যর্থ হওয়ার পর চলতি বছরে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হলেও জোরালো কোনো কর্মসূচির দিকে পা ফেলেনি বিএনপি। বিগত কয়েক মাস যাবৎ কাক ডাকা ভোর বা সকালে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ঝটিকা মিছিল করতে দেখা গেছে রুহুল কবীর রিজভীকে।

১৯৭৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বিভিন্ন পথ-মতের অনুসারীদের এক প্লাটফর্মে এনে’ এই দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আব্দুল আউয়াল খান বলেন, ‘৪০ বছরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) হাঁটি হাঁটি পা পা করে এ পর্যন্ত এসেছে। পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে শৈশব-কৈশর-তারুণ্য-যৌবন পেরিয়ে পূর্ণাঙ্গ যুবকে পরিণত হচ্ছে। এই ৪০ বছরে অসংখ্য নেতাকর্মীকে হারাতে হয়েছে, অনেকে গৃহহারা ও নিখোঁজ হয়েছেন। তারা জাতীয়তাবাদী শক্তির পতাকা তলে এসে এর কার্যক্রমে আবদ্ধ থেকেছেন। এই হৃদ্যতা ও ভালোবাসা ভবিষ্যতে দেশের মানুষকে আরও উজ্জীবীত করবে।’

রাজনীতিতে বিএনপির অবদান প্রসঙ্গে যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘চার দশকের রাজনীতিতে বিএনপির সবচেয়ে বড় অবদান বাকশাল নামক একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফেরত আনা। এছাড়া বিএনপি দেশের মানুষকে একটা অবিতর্কিত জাতীয় পরিচিতি দিয়েছে। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি ও পাহাড়ি বলে যে বিভাজন ছিল, বাঙালি বলতে পার্শ্ববর্তী দেশেরও যে সংশ্লিষ্টতা ছিল- সেগুলোকে পরিষ্কার করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ উপহার দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানই প্রথম বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রফতানি করে দেখিয়েছেন যে মানুষ দিয়েও দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা যায়। নারী শিক্ষা এবং জনস্বাস্থ্যে খালেদা জিয়ার যে অবদান সেটা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত এবং স্বীকৃত। বিনা বেতনে পড়াশুনা করা, মেয়েদের বৃত্তি দেয়া এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্য সেবা এবং দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিএনপির ব্যাপক অবদান আছে। যা সারা দেশের মানুষের চোখের সামনে দৃশ্যমান। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বিএনপি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ, গুণীজনদের সম্মাননা দেয়া, একই সঙ্গে শিশু-কিশোরদের প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে ভবিষ্যত নেতৃত্ব তৈরি করা- সবগুলো কাজেরই সূচনা করেছে। এই বিএনপি কৃষি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে গরু, হাঁস-মুরগির খামার তৈরি, মাছ চাষ, বনায়ন এসব ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ নিয়েছে।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সময় দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, বর্তমানে তিনি আলাদা দল গঠন করছেন।

চার দশকে বিএনপির রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএনপি তো অত্যন্ত জনপ্রিয় একটা দল, যথেষ্ট জনসমর্থন রয়েছে। আমার মনে হয় সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থ হলেও প্রচুর জনসমর্থন থাকায় বিএনপি এখনও বেঁচে আছে। একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং ধরে রাখতে হলে দলে পরিবর্তন আনতে হবে। এখন বিএনপির কোনো স্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, যার মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়। ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া কমিটি দিয়ে একটা বড় পার্টি চলতে পারে না, এটার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত কর্মীদের ইচ্ছার প্রতিফলনে পার্টির নেতৃত্ব নির্বাচিত হতে হবে। বিএনপিতে এখন পদ বাণিজ্য হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। এর বিরুদ্ধে শীর্ষ নেতাদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাকে সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ ও সাচ্চা করতে হবে। তাহলে বিএনপি একটা বিরাট শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।’

তিনি বলেন, ‘সহিংসতা ও কোনো প্রকার সংঘাতপূর্ণ কর্মসূচি ছাড়া জনগণের হৃদয় জয় করতে যে ধরনের কর্মসূচি প্রয়োজন তেমন কর্মসূচি দিয়ে বিএনপিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে তারা আওয়ামী লীগের মতো একটি শক্তিশালী দলকে মোকাবিলা করতে পারবে।’

দল গঠনের সময় যে আদর্শ ছিল বিএনপি কি এখন সে অবস্থায় আছে? – এমন প্রশ্নে নাজমুল হুদা বলেন, ‘সেই আদর্শে তো নেই। সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি তো বিএনপির আদর্শে ছিল না। পদ বাণিজ্যও তো বিএনপির ভেতরে কখনও যাওয়ার কথা না। একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নির্বাচিত নেতৃত্বের কথাই বলে এসেছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র যদি পড়েন তাহলে দেখতে পাবেন তৃণমূল পর্যায় থেকেই কিন্তু সেখানে নেতৃত্ব নির্বাচনের কথা। সেটা তো হচ্ছে না। একটা পর্যায়ে ওপর থেকে কমিটি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিএনপির সবচেয়ে দুর্বল দিক হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এর কারণ হচ্ছে ওপর থেকে কমিটি চাপিয়ে দেয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি নির্বাচিত হলে এই কোন্দাল হতে পারতো না।’

চার দশকে বিএনপির রাজনীতি প্রসঙ্গে দলটির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনা প্রধান লে. জে. (অব.) মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি একটা বৈপ্লবিক দল এবং বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশের অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে এই দলের সৃষ্টি হয়েছে এবং জিয়াউর রহমান সেই সময় এই দলের নেতৃত্ব দেন। তখন বাংলাদেশের একটা কঠিন সময় ছিল। আমি মনে করি উনি অত্যন্ত সাহসী বিরল ব্যক্তিত্ব। সেই দলের আদর্শ নীতি উনি রেখে গেছেন। তিনি গত হয়ে গেছেন। আমরাও হয়তো তার আদর্শ ধরে রাখতে পারিনি। তার জন্য বিএনপির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। দেশের এখন যে অবস্থা আমি মনে করি সব দলকে এসে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে।’

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে