এখনও রাজপথে খুব বেশি তাপ নেই। তবে একাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে শিগগিরই রাজনৈতিক এই উত্তাপ দৃশ্যমান হবে বলে ধরে নেয়া যায়।
কারণ ক্ষমতাসীনদের বাইরে রাজনৈতিক সব উইং সক্রিয় হচ্ছে চলতি মাসে। আর তাতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠবে বলে ধরে নেয়া যায়। এক্ষেত্রে বিকল্প জোটগুলোর উত্তাপে পাল চড়াবে রাজপথের প্রধান বিরোধীপক্ষ বিএনপিও।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন। সে লক্ষ্যে নভেম্বরে তফশিল ঘোষণা করতে নিজেদের ৮০ ভাগ প্রস্তুতি শেষ করেছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।
আর এই নির্বাচন কেন্দ্র করে মাঠ নিজেদের দখলে রাখতে ও ভোটের মাঠে নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে সেপ্টেম্বরকেই বেছে নিচ্ছে রাজনীতির সবপক্ষ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায়, জনগণের মন কেড়ে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে। বিএনপিসহ বিকল্প একাধিক জোট চায় ক্ষমতার পলাবদল।
মাঝখানে কাগুজে বিরোধীদল জাতীয় পার্টি আছে মাখন খাওয়ার নেশায়। আওয়ামীপন্থী বামরাও ক্ষমতায় থাকতে মরিয়া। সেজন্য জোট অটুট রাখতে ক্ষমতাসীনদের তোষামোদিতেই ব্যস্ত তারা।
নির্বাচনকে ঘিরে বছরের জানুয়ারি থেকেই মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। ধাপে ধাপে বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলায় সমাবেশ করে নিজেদের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে ভোট চেয়েছেন শেখ হাসিনা।
এদিকে, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও (জাপা) নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে আগে থেকেই ভোটের মাঠে নেমেছে।
বিএনপি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ আর আন্দোলনের হুংকারে ব্যস্ত থেকেছে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী বামজোট ও ছোট ছোট দলের নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ ছিল। সম্প্রতি সব পক্ষ রাজনীতিতে সরব হয়েছে। সেপ্টেম্বরেই মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে তারা।
এবার ভোটের মাঠে ব্যস্ত আওয়ামী লীগকে টেক্কা দিতে জোট গঠনে ব্যস্ত বিএনপি। আর এর মধ্যদিয়ে আওয়ামীবিরোধী জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে তারা।
১ সেপ্টেম্বর থেকে মাঠে নেমেছে ‘প্রবীণদের জোট’। এই জোটের নেতৃত্বে আছেন প্রবীণ রাজনীতিক অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি. চৌধুরী), ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুরসহ একাধিক নেতা। তারা সম্প্রতি বৈঠক করে রাজনীতির পালে হাওয়া দিয়েছেন। সেখানে এসব প্রবীণরা জাতীয় ঐক্য পক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। জানিয়েছেন, জাতির ক্রান্তিলগ্নে তারা পাশে থাকতে চান। এজন্য তারা নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন বলে জানিয়েছেন।
আগামী ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ড. কামাল হোসেন আহ্বান করেছেন নাগরিক সমাবেশের। এতে জামায়াতে ইসলামী বাদে প্রায় সব দলকেই আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে জানা গেছে।
তাদের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতেই এসব কর্মসূচি বলে জানিয়েছেন যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের একাধিক নেতা।
এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমরা যুক্তফ্রন্ট বর্তমান সরকারের লুটপাট, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে শিগগিরই মাঠে নামব। এছাড়া নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্যও কাজ করব।’
এদিকে, যুক্তফ্রন্ট ও ড. কামাল হোসেনের গণফোরামসহ বিভিন্ন দলের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছে অস্তিত্ব টেকাতে মরিয়া বিএনপি। একইসঙ্গে তারা নিজেদের অস্তিত্ব টেকাতে সেপ্টেম্বরেই মাঠে নামছে। শনিবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর জনসমাবেশের মাধ্যমেই রাজপথে পা রেখেছে তারা।
সমাবেশ থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে দলটি। এরপর ধারাবাহিকভাবে সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচি দেবে বিএনপি।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে মাঠে নামছে সিপিবি-বাসদ নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক মোর্চার ৮ দলীয় জোট। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মুক্তি ভবনে মতবিনিয় করার মাধ্যমে তাদের কর্মসূচি শুরু হয়।
তারা জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার দাবিসহ নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক জানান, চার দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জোটটি দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আগামী ৮ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টায় মুক্তিভবনের প্রগতি সম্মেলন কক্ষে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হবে।
এছাড়া অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ দেশব্যাপী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে দাবি দিবস পালন করবে বামজোট।
২০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সীমাহীন দুর্নীতি ও দুঃশাসন প্রতিরোধে এবং ব্যাংক ডাকাতির লুটপাটের প্রতিবাদে ১১ অক্টোবর সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হবে।
একই দিন জেলা পর্যায়ে জেলা নির্বাচন অফিস অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল পালিত হবে। অন্যদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে জোটের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট দাবি আদায়ে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসজুড়ে দেশব্যাপী জনসভা করার কথাও জানান সাইফুল হক।
পথ ছাড়ছে না জাপা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতায় থাকার জন্য ঠান্ডা মাথার রাজনীতি করে এগোচ্ছে জাতীয় পার্টি। তারা চায় ক্ষমতা; সেটা জোটগতভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে হোক বা বিরোধী দলে থেকে। ইতোমধ্যে দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘোষণা দিয়েছেন, ‘বিএনপি এলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করবেন। না হয়, পৃথকভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে।’
এক্ষেত্রে এরশাদের জাতীয় পার্টি ফের বিরোধী দলে থাকার টার্গেটেই এগোবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এরশাদের নেতৃত্বাধীন এ দলটিও সেপ্টেম্বরের ৮ তারিখে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে যৌথসভা ডেকেছে। যৌথসভায় কেন্দ্রীয় কমিটি, জেলা, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা অংশ নেবেন। এরশাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় ওই সভা থেকেও নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচি আসতে পারে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নির্বাচন এলে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়াবে এটা স্বাভাবিক। তারা জনগণের সঙ্গে আছেন। যেসব উন্নয়ন করেছেন, তাতে জনগণও তাদের সঙ্গে থাকবে। এজন্য তারা উন্নয়ন প্রচারে সময় ব্যয় করতে চান।
রাজনীতির মাঠের উত্তাপ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী নির্বাচন হবে সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এজন্য আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না। কেউ আন্দোলন করতে চাইলে অহিংস আন্দোলনকে আমরা স্বাগত জানাব। সহিংস আন্দোলন করলে জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নেবে।
নবীন-প্রবীণ, ডান-বাম আর জোট-মহাজোটের লড়াই কার্যত কতটুকু উত্তাপ ছড়াবে, সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে এই সেপ্টেম্বরের রাজনীতির পরিবেশেই স্পষ্ট হবে, কী হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের, কারা গঠন করবে সরকার!