রাজধানীর রাস্তাজুড়ে বসানো হবে ১৬ হাজার ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। ‘ঢাকা সিটি ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম’ নামে পুলিশের এই প্রকল্পে ব্যয় হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আব্দুল গনি রোডের ১৪ তলা ভবনের কন্ট্রোল রুমে বসে রাজধানীর সব রাস্তার সার্বিক চিত্র নজরদারি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবে পুলিশ। কম্পিউটার মাউসে এক ক্লিকেই মিলবে কাক্সিক্ষত সব তথ্য। রাজধানীতে অনাকাক্সিক্ষত কোনো ব্যক্তি ঢুকতেই ফেইস ডিটেকশনের মাধ্যমে এলার্ম বেজে উঠবে। কেপিআই জোনে কোনো ব্যক্তি নির্দিষ্ট স্থান ব্যতীত অন্যত্র দিয়ে প্রবেশ করতে চাইলেও বেজে উঠবে এলার্ম। ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে অডিও এবং ভিডিও কনফারেন্স করা যাবে। ফলে রাস্তায় সংঘটিত যে কোনো ধরনের অপরাধ ও অপরাধী মুহূর্তেই শনাক্ত করে তাৎক্ষণিক অভিযান চালানোর পাশাপাশি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির পর অর্থ, পরিকল্পনা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সায় পেয়ে কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে লিখিত সুপারিশ পেলেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
এ প্রসঙ্গে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের অতিরিক্ত ডিআইজি (উন্নয়ন) মো. মোজাম্মেল হক বলেন, পুলিশের কাজের ধরন ও পরিধি বদলেছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্রযুক্তি নির্ভরতা এখন জরুরি। ঢাকার সব রাস্তার পাশে উন্নত প্রযুক্তির সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা গেলে আইনশৃঙ্খলা ও যানজট পরিস্থিতি উন্নতিসহ অনেক মামলার তদন্তে সহায়ক তথ্য প্রমাণ মিলবে। এতে গানশট একুয়াশটিং সিস্টেম, কল ট্র্যাকিং, ই-পুলিশিং, পরিত্যক্ত বস্তু শনাক্তসহ সব রকম আধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটায় অফিসে বসেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধীর পিছু নিতে পারবে পুলিশ।
সূত্রমতে, ২০১৫ সালে পরিকল্পনা কমিশনের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির সবুজ পাতার আওতায় রাজস্ব খাত থেকে এক কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহবান করা হয়। যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, মালয়েশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১৬টি দেশি-বিদেশি কোম্পানি এতে অংশ নেয়। পরে ৭টি কোম্পানি বাছাই করে চীনের হুয়াশিন কনসালিং কোম্পানিকে কাজ দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও পুলিশের বিশেষজ্ঞ টিমও সঙ্গে ছিল।
সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ঢাকা মাহানগর পুলিশ (ডিএমপি), সিআইডি, র্যাব, এসবি, পিবিআই, এসপিবিএনসহ পুলিশের সবকটি ইউনিটের সমন্বয় বৈঠক হয়। পরে ৩ হাজার ২০৫টি ক্রাইম পয়েন্ট, ৩৩৫টি ট্রাফিক পয়েন্ট, ৪১ট গুরুত্বপূর্ণ স্থান, ১১০টি চেক পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়। যানজট এলাকার জন্য চিহ্নিত হয় ২৬০টি পয়েন্ট। এ জন্য মোট ৪ হাজার ১২৪টি স্পটে ১৬ হাজার ২৪৬টি ক্যামেরা বসানো হবে। এর মধ্যে অপরাধ চিহ্নিতের জন্য থাকবে ১৩ হাজার ৩০টি ক্যামেরা। সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩০৭টি ক্যামেরা থাকবে গুলশান এলাকায়।
সূত্র জানিয়েছে, প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী সব ধরনের ফুটেজ ৪৫ দিন এবং গুরুত্ব বিবেচনায় কোনো কোনো ফুটেজ এক বছর সংরক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া অনেক ফুটেজের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা মানা হবে। পুলিশের সুবিধার্থে করা গ্লোবাল ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) ম্যাপের মাধ্যমে এর কার্যক্রম চলবে। এ জন্য দেশি-বিদেশি সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার বিষয়ে প্রশিক্ষিত লোক সার্বক্ষণিক কাজ করবেন। অপরাধী, অপরাধে ব্যবহৃত যানবাহন শনাক্তের পাশাপাশি ফুটপাতের ডাস্টবিন বা ম্যানহোলের ঢাকনা চুরির দৃশ্যও দেখা যাবে।
প্রস্তাবিত ৫ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে ক্যামেরা ক্রয় ও আনুষঙ্গিক কাজে ব্যয় হবে ৩ হাজার দুইশ কোটি টাকা। প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এক হাজার কোটি টাকা এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য খাতে ব্যয় হবে ৮শ কোটি টাকা। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগবে দুই বছর। কন্ট্রোল রুমের বাইরে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, র্যাব, এসবি, সিআইডি, ডিএমপি, পিবিআই, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর, নগর ভবন এবং সব থানায় থাকবে মনিটরিং রুম। ঢাকার আশপাশ এলাকার জন্য মোবাইল কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার থাকবে। যাতে একটি মাইক্রোবাসের মধ্যে ৫০টি ক্যামেরা ও প্রযুক্তি থাকবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বিআরটিসি, বিটিসিএল, সামিট গ্রুপ, ফাইবার অপটিকস, বিদ্যুৎ বিভাগ, সিটি করপোরেশন, রাজউকের সহায়তা নেবে পুলিশ। এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষ করেছে তারা। কাজ শেষে ২০১৯ সালে এই প্রকল্প যাত্রা শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও এখনো কাজই শুরু হয়নি। তাই নতুন টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২১ সাল।
সূত্র আরো জানায়, এক দশক আগে ফলেক ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর রাস্তার পাশে সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু হলেও তা যুগোপযোগী ছিল না। বলতে গেলে রাস্তার পাশে বসানো ১৮৫টি ক্যামেরা কাজ শুরুর আগেই নষ্ট হয়ে যায়। তবে আব্দুল গনি রোডের কন্ট্রোল রুম, গাড়ি এবং যন্ত্রপাতিগুলো এখনো ব্যবহার উপযোগী রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ঢাকার অনেক রাস্তার পাশে সিসি ক্যামেরা দেখা গেলেও সেগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে স্থাপন করা হয়নি। অনেক জোনের উপপুলিশ কমিশনার এবং থানার উদ্যোগে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সেখান থেকেই তা মনিটরিং করা হচ্ছে।