দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সক্রিয় কোনো কর্মসূচি কিংবা কর্মসূচি নিয়ে নেই কোনো হুংকার। তারপরও কখনও ঘরোয়া কর্মসূচি আবার কখনো বা মানববন্ধেনের মতো ‘নিরীহ’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দলের নেতাকর্মীকে আটকের বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন দলটির নেতারা।
তাদের ভাষ্য, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে হঠাৎ করেই পুলিশ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে বিএনপির নেতাকর্মীদেরকে আটক করা শুরু করেছে। এটা বুঝতে বাকি নেই, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচনের জন্য ষড়যন্ত্র করছে সরকার।
গেল ঈদুল আজহার পর থেকে সারাদেশে প্রায় এক লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। শত শত নেতাকর্মীকে ‘ভৌতিক’মামলায় আটক করা হচ্ছে বলে দাবি বিএনপির।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সারাদেশে লক্ষাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সরকার ভৌতিক মামলা দিয়েছে। ১২ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রামেগঞ্জেও বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘরে ঘুমাতে পারছেন না। এভাবে মিথ্যা মামলা, অত্যাচার-নির্যাতন, গুম-খুন করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না।’
গত সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধন সম্পর্কে দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘আজকের মানববন্ধন ছিল নিরীহ কর্মসূচি। পুলিশ ওঁৎ পেতে ছিল বিএনপি নেতাকর্মীদের আটক করার জন্য। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে তথ্য এসে পৌঁছেছে, তাতে দুই শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। এখনো সব তথ্য আসেনি। সব তথ্য হাতে আসলে আপনাদের বিস্তারিত জানাতে পারব।’
হঠাৎ করেই বিএনপির নেতাকর্মীদের এমন গ্রেফতারকে ভিন্ন চোখে দেখছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার অত্যন্ত আতঙ্কিত। তারা দেখছে সারাদেশে তাদের কোনো জনপ্রিয়তা নেই, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এখন তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে দুর্বল করার জন্য এবং নির্বাচন থেকে বাইরে রাখতেই এ সকল ষড়যন্ত্র।’
তিনি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত জেলে। মূল মামলায় জামিন পাওয়ার পরও তাকে মুক্তি দেয়া হচ্ছে না। এই যে ধরপাকড়, এসব কিছু খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো দেশে আর কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবেদীন ফারুক বলেন, ‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার শুরু হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় তার বেড়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে, ভোটের রাজনীতি করার উদ্দেশ্য বর্তমান সরকারের আর নেই।’
তিনি আরও বলেন, এটা শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশে সরকার পরিকল্পিতভাবে গণগ্রেফতার শুরু করেছে। যাতে বিএনপি আগামী নির্বাচনে না যায়। তাছাড়া বিএনপি নির্বাচনে গেলেও যাতে নেতাকর্মীরা জনগণের কাছে যেতে না পারে। এটা তাদের লক্ষ্য।’
এক দিনে আটকের পরিসংখ্যান:
গত সোমবার বিএনপির মানববন্ধন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারাদেশে প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। বিএনপি পক্ষ থেকে এর একটি চিত্র তুলে ধরা হয়।
বলা হয়, এদিন বিএনপি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সহ-সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, নির্বাহী কমিটি সদস্য ও সাবেক ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ লেবার পার্টির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলমকে আটক করেছে পুলিশ।
এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি শরিফ হোসেন, রমনা থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক বাবু, কোতয়ালী থানা যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামনু, থানা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক মিরাজুল ইসলাম টয়, দক্ষিণ যুবদল নেতা মো. সানোয়ার, মো. ইমরান, মো. সাকিব, ওরিন, সোহাগ, ইলিয়াস, মিলন, জসিম, মহসিন, রাহাদ ও ইউছুফ, যাত্রবাড়ী থানা যুবদল নেতা জসিম খান, যুবদল নেতা আব্দুল ওয়াছেদ, যুবদল নবাবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদুজ্জামান, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ সুলায়মান, যুগ্ম-সম্পাদক মো. আকবর হোসেন, দক্ষিণখান থানা যুবদল সভাপতি শেখ আব্দুল্লাহ রাসেল, উত্তরখান থানা যুবদল নেতা হোসেন মোল্লা, ওমর ফারুক, মো. সুরুজ মিয়া, খিলক্ষেত থানা যুবদল নেতা নাজমুল, শেরেবাংলা থানা যুবদল নেতা মান্নান হাওলাদার, গুলশান থানা যুবদল সাংগঠনিক সম্পাদক মেহরান জাবিন ফারুক, মাসুদ পারভেজ, মো. রাজিব আলী রজ্জব, রুপনগর থানা যুবদল নেতা মো. জাহাঙ্গীর আলম, মো. মনির হোসেন, রতন মিয়া, শেরেবাংলা থানা যুবদল নেতা মো. শফিকুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, রমনা থানা যুবদল নেতা শরিফ, মিজান, ক্যান্টনমেন্ট থানা যুবদল সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, যুবদল নেতা নুর মোহাম্মদ, শফি উল্লাহ, মাসুমসহ অর্ধশতাধিক যুবদল নেতা-কর্মী আটক করে নিয়ে গেছে পুলিশ।
স্বেচ্ছাসেবক দল: স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য এইচ এম জাফর আলী খান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শাহাবুদ্দিন পাটোয়ারী, হেলাল উদ্দিন, ওয়ারী থানা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন রাসেল, মতিঝিল থানা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা মিজানুর রহমান, রহমত ও হেলাল, কামরাঙ্গীরচর থানা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা ইউনুস ও লিটন, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবুল হোসেন, মনির হোসেনসহ ৩০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর: ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নিউমার্কেট থানা বিএনপি নেতা মতিউর, শাহবাগ থানা বিএনপি নেতা কুতুবুদ্দিন, মামুন, ফারুক, শাহ আলম, মোক্তার, কদমতলী থানা বিএনপি নেতা জসিমউদ্দিন, মহসিন, ইউছুফ, পল্টন থানা বিএনপি নেতা আবুল হোসেন, আরমান হোসেন, মো. শামীম, মোহাম্মদ আলী, চকবাজার থানা বিএনপি নেতা রনি, কামরাঙ্গীর চর থানা বিএনপির নেতা মো. আনু, মো. নুরু, শিবলু, আলাউদ্দিন, রমনা থানা বিএনপি নেতা মোতালেব হোসেন রুবেল, মানিক হোসেন, মো. রিপন, মো. ফিরোজ, বংশাল থানা বিএনপি নেতা মাহবুব, গেন্ডারিয়া থানা বিএনপি সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াসেক বিল্লালসহ ৪০ জনের অধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদল: কোতয়ালী থানা যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মামুন, যুবদল নেতা আলমগীর গ্রেফতার।
ছাত্রদল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূর্যসেন হল শাখার ছাত্রদল নেতা আনোয়ার, আলতাফ, মুজিব হল শাখার ছাত্রদল নেতা মশিউর, ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি গাজী মনিরুজ্জামান মানিক, কেন্দ্রীয় সহ-মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিন, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা রেদোয়ান হোসেন, নাহিয়ান হোসেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ, ইউরোপিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা আলামিন বাবলু, স্ট্যাম্পফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা ডালটন হোসেন মনির, বাংলাদেশ ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল নেতা রাকিব, মনিরুল ইসলাম মনির, আলামিন বাবু, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রনেতা আবদুল হক, সাইফ সবুজ, আফজাল হোসেন, বাংলা কলেজ শাখার ছাত্রদল নেতা রওনোকুল, তাহাফিন রনক, তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম-সম্পাদক আবির, কাজী সাইফুল, বাইজিদ, সহ-সাধারণ সম্পাদক মুরাদ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ইমমান, ক্রীড়া সম্পাদক হুমায়ুন কবির, ছাত্রদল নেতা তানভীর, মিজানুর, মোশাররফ, রিয়াজ, বাইজিদ মোস্তাকিন, ঢাকা কলেজ ছাত্রদল সহ-সভাপতি মনিরুজ্জামান, মাজেদুল ইসলাম মাজেদ, সাকিল মাহমুদ, ঢাকা মহানগর পূর্ব নিউমার্কেট ছাত্রদলনেতা আপেল মাহমুদ, পল্টন থানা ছাত্রদল নেতা নোমান, একরাম, আফজাল, গাজীপুর জেলার ৪০ নং ওয়ার্ডের ছাত্রদল নেতা মাসুদ গ্রেফতার হয়েছেন।
মোহাম্মদপুর থানা: থানা বিএনপি নেতা কাশেম, খোকন, সুমন, মিন্টু, আখতার হোসেন অভি গ্রেফতার হয়েছেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পাভেল শিকদার, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্রনেতা ফজলে রাব্বি, সাইফ আলী, কদমতলী থানা ছাত্রদল নেতা আশিকুর রহমান সুজন, সরকারী সোহরাওয়ার্দী কলেজ শাখা ছাত্রদল নেতা মো. শিপন মাহমুদ, দোহার থানা ছাত্রদল নেতা আল আমিন, ডেমরা থানা ছাত্রদল নেতা খন্দকার মেহেদী হাসান, কবি নজরুল কলেজ ছাত্রদল নেতা রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ আটক করেছে পুলিশ।
এ ছাড়া পল্টন থানা শ্রমিক দল নেতা রাসেল, পল্টন থানা বিএনপি নেতা আবুল হোসেন বিএনপি নেতা আরিফ হোসেন, মো. শাহ আলম খান, মো. সেলিম, সিরাজুল ইসলাম মানিক এবং মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির চার নেতাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের গাড়ি চালক আবুল কালামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এদিকে, গাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বিএনপির মানববন্ধন কর্মসূচিতে পুলিশ অতর্কিত হামলা ও গুলি চালায়। এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মরহুম আ স ম হান্নান শাহর ছোলে শাহ রিয়াজুল হান্নান ও কাউন্সিলর হান্নান মিয়া হান্নুসহ ২৫ জনের অধিক নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশি লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণে মহিলা দলের সাবেক সভাপতি আনোয়ারা বেগম, যুবদল নেতা সাজেদুল মোল্লাহ, সুমনসহ ২০ জনের মতো নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে অক্টোবরে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নভেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে এবং ডিসেম্বরের শেষ দিকে নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হতে পারে।