সরকারের চাপ এবং হুমকির মুখে দেশ ছেড়েছেন বলে দাবি করেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। একটি গোয়েন্দা সংস্থা এই হুমকি দিয়েছিল বলে অভিযোগ তার। খবর বিবিসি বাংলা।
আত্মজীবনীমূলক বই ‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেমোক্রেসি’তে সিনহা বর্ণনা করেছেন কোন পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়েছি এবং তারপর কেন তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন।
সিনহা লিখেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি যেন সরকারের পক্ষ যায়, সেজন্যে তার ওপর ‘সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে চাপ তৈরি করা হয়েছিল।’
সিনহার পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল ২০১৭ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত একটি মামলার আপিলের রায়কে কেন্দ্র করে। এ রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সরকারের কাছ থেকে প্রচণ্ড চাপের মুখে বিচারপতি সিনহা দেশ ছেড়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।
সিনহা লিখেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এবং তার দলের অন্যান্য সদস্য ও মন্ত্রীরা পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে যাবার জন্য আমার কঠোর নিন্দা করেন। প্রধানমন্ত্রীসহ ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা আমার বিরুদ্ধে অসদাচরণ এবং দুর্নীতির অভিযোগ এনে বদনাম করতে শুরু করেন।’
‘আমি যখন আমার সরকারি বাসভবনে আবদ্ধ, আইনজীবী এবং বিচারকদের আমার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না, তখন সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় – আমি অসুস্থ, আমি চিকিৎসার জন্য ছুটি চেয়েছি।’
‘একাধিক মন্ত্রী বলেন, আমি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাব।’
‘অক্টোবরের ১৪ তারিখ, যখন আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই- তখন একটি প্রকাশ্য বিবৃতিতে আমি পরিস্থিতি স্পষ্ট করার চেষ্টায় একটি বিবৃতি দেই যে আমি অসুস্থ নই এবং আমি চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না।’
‘আমি আশা করছিলাম যে আমার প্রত্যক্ষ অনুপস্থিতি এবং আদালতের নিয়মিত ছুটি- এ দুটো মিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সহায়ক হবে, এবং শুভবুদ্ধির উদয় হবে, সরকার ওই রায়ের যে মর্মবস্তু- অর্থাৎ বিচারবিভাগের স্বাধীনতা যে জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর- তা বুঝতে পারবে।’
‘শেষ পর্যন্ত ভীতি প্রদর্শন এবং আমার পরিবারের প্রতি হুমকির সম্মুখীন হয়ে আমি বিদেশ থেকে আমার পদত্যাগপত্র জমা দেই।’
সিনহা লেখেন, তার এ বইতে তার ব্যক্তিগত ও বিচার বিভাগে কর্মজীবনের কথা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রতি চ্যালেঞ্জসমূহ, বিচারবিভাগ ও রাজনীতিবিদদের মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, পুলিশের বাড়াবাড়ি, জরুরি অবস্থার প্রভাব, এবং ‘ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ডিজিএফআইয়ের অর্থ আদায়ের’ বিবরণ আছে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এ নিয়ে বিবিসিকে সাক্ষাতকারও দিয়েছেন। এতে তিনি বলেন, ‘আমাকে যখন কমপ্লিটলি হাউস অ্যারেস্ট করা হলো, …তখন বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিদিন একজন করে ডাক্তার আমার কাছে পাঠানো হতো। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না।’
বিদেশ যেতে চাপ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করার কথাও বিবিসিকে জানান সিনহা। তবে তাকে জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন না।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সেনা শাসনামলের মতো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বদলে সংসদের হাতে নেয়া হয়। পরে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বিশেষ বেঞ্চ ওই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয়। সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করে এবং সাত সদস্যের একটি বেঞ্চে আপিলের শুনানি হয়।
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার বইতে লেখেন, ‘জুলাইয়ের ৩ তারিখ প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বহাল রাখে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ১ তারিখ সর্বসম্মত রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়।’
ওই সিদ্ধান্তের পর সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখে পার্লামেন্ট একটি প্রস্তাব পাস করে- যাতে সেই রায়কে বাতিল করার জন্য আইনি পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়।