সরকারের শেষ দুই বছরে সরাসরি বিদেশি (এফডিআই) বিনিয়োগ নিবন্ধনে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যা আগের বছরগুলোর তুলনায় প্রায় সাড়ে ৪ গুণ বেশি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারের অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করার যে সিদ্ধান্ত, সেটার প্রভাব পড়ছে বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধনে। তবে এ বিনিয়োগ নিবন্ধন উৎপাদনে যাওয়া নির্ভর করবে অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার ওপর।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যানুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে ১০ হাজার ৭৫৬ মিলিয়ন ডলারের। আগের বছর বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছিল ১ হাজার ৯৬১ মিলিয়ন ডলার। এক বছরে বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি হার ৪৪৮ শতাংশ। ১৬৭টি প্রকল্পের বিপরীতে এ নিবন্ধন হয়েছে। এ বছর নিবন্ধনে বিপরীতে কর্মসংস্থান প্রাক্কলন করা হয় ৫৭ হাজার ১১৯ জন। পরের বছর ২০১৭-১৮-তে কিছুটা কমে ১৬০টি প্রকল্পের বিপরীতে ১০ হাজার ৩১৬ মার্কিন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়। এ পর্যায়ে বিনিয়োগে নিবন্ধনে অর্থের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও কিছুটা কমেছে। তবে উচ্চ বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রয়েছে।
এ বছর কর্মসংস্থান প্রাক্কলন করা হয় ২৬ হাজার ৬৯১ জন। এর আগের বছরগুলোতে বিনিয়োগ পরিস্থিতির চিত্রটি অনেক অস্থির ছিল। দুই বছর বৃদ্ধি পায় তো, আরেক বছর হঠাৎ করে কমে যায়। তারপরও এ বছরগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল শেষ দুই বছরে বিনিয়োগ নিবন্ধনের চেয়ে এক চতুর্থ। কোনো কোনো বছরে অর্ধেক।
বছরভিত্তিক তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০৮-৯ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন হয় ২,১২৩ মিলিয়ন ডলারের; ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৮৯০ মিলিয়ন ডলারের, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৫,১০৪ মিলিয়ন ডলারের; ২০১১-১২ অর্থবছরে ৪,৪৭০ মিলিয়ন ডলারের; ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২,৭৩৩ মিলিয়ন ডলার; ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২,৩৮৩ মিলিয়ন ডলার; ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১,০৩২ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন হয় ১,৯৬১ মিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষকদের মতে, বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে রয়েছে কর্মক্ষম শ্রম শক্তি এবং তা তুলনামূলক সস্তায় মেলে। সেইসঙ্গে রয়েছে বড় বাজার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্ভাবনা থাকার পরও এসব বিদেশি বিনিয়োগের পথে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় শিল্পের জন্য জমির অপর্যাপ্ততা।
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, সরকার ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন বেড়ে গেছে।
এদিকে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন, ২০১০-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রতিষ্ঠা করে সরকার। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় কাজ শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এগুলোর মধ্যে সরকারি উদ্যোগে চারটি এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) আওতায় বেসরকারি উদ্যোগে ছয়টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে।
জানা গেছে, অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার উদ্যোগে সরকার আগামী ১৫ বছরে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে এই ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চায়। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে দেশে অন্তত ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা শিল্পায়নের মাধ্যমেই সম্ভব বলে মনে করছে সরকার। দেশের শিল্পায়ন এগিয়ে নিতে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম চলছে।
আহসান এইচ মনসুরের মতে, এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নের ফলে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের মাঝে যে সাড়া ফেলেছে ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ দুই অর্থবছরে বিনিয়োগ নিবন্ধন তারই প্রমাণ। তবে তা নির্ভর করবে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল কত দ্রুত দৃশ্যমান হবে তার ওপর।
প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নের কাজ যদি দ্রুত শেষ না করা যায় তাহলে যেসব বিনিয়োগ নিবন্ধন হয়েছে তা নিবন্ধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, আলোর মুখ দেখবে না বলে মনে করেন এই গবেষক। তার মতে, গত দুই বছরে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধনের যে ধারা সূচিত হয়েছে তা অব্যাহত রাখতে হলে এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্তত কয়েকটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে উৎপাদনে নিয়ে আসতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধনের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আবার পিছিয়ে যাবে।