২০১৫ সালে প্রতিদ্বন্দ্বি অন্য যুবরাজদের ডিঙ্গিয়ে ৩৩ বছর বয়সী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেতা হন। রক্ষণশীল সৌদি আরবে সেই সময় তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার উদ্যোগ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
সম্প্রতি সৌদি রাজপরিবারের কট্টর সমালোচক সাংবাদিক জামাল খাশোগির অন্তর্ধান আবারও সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে (এমবিএস) আলোচনায় নিয়ে এসেছে।
চলতি বছরের মার্চে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। গণমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া নতুন এই যুবরাজ সেসময় টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ স্টোরিতে স্থান পান। মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল সিবিএসের সিক্সটি মিনিট অনুষ্ঠান ও ব্লুমবার্গকে সাক্ষাৎকার দেন তিনি।
তবে খাশোগির অন্তর্ধান সৌদি এই যুবরাজের অন্ধকার জগৎকে সামনে নিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির সমালোচক ও মানবাধিকার কর্মীদের বন্দী করে রাখা। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি হস্তক্ষেপ হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের প্রাণহাণি ঘটিয়েছে। পাশাপাশি বর্তমানে সৌদিতে নজিরবিহীন শিরশ্ছেদ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইয়েমেনে ধ্বংসযজ্ঞ :
২০১৫ সালে প্রতিবেশি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে সৌদি আরব। দেশটির হুথি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলগুলো মুক্ত করার প্রত্যয়ে বিমান হামলা শুরু করে। লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টায় মার্কিন সহায়তায় সৌদি-আরব আমিরাত জোট এখন পর্যন্ত ইয়েমেনে ১৬ হাজারের বেশিবার বিমান হামলা চালিয়েছে।
দীর্ঘদিনের এই বিমান হামলার পাশাপাশি ইয়েমেনের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ হোদেইদাহ বন্দর অবরোধ করে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বি ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের অস্ত্রের মূল জোগান এই বন্দর হয়ে ইয়েমেনে প্রবেশ করতো।কিন্তু সৌদি জোট হোদেইদাহ বন্দর অবরোধ করায় দেশটিতে জরুরি মানবিক ত্রাণ সহায়তাও পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। ২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে অনেকের প্রাণ গেছে যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে। লাখ লাখ মানুষ হয়েছেন বাস্তুচ্যুত।
চলতি বছরের এপ্রিলে টাইম ম্যাগাজিনের সঙ্গে আলাপকালে এমবিএস ইয়েমেনে সৌদি জোটের হামলার পক্ষে সাফাই গান। তিনি বলেন, যেকোনো ধরনের সামরিক অভিযানে ভুল হতে পারে… অবশ্যই, সৌদি আরব অথবা জোটের কোনো ভুল হয়ে থাকলে সেটি অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছে।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করা :
নিয়মিত সফরের অংশ হিসেবে সৌদি আরবে গিয়ে চাঞ্চল্যকর বন্দিদশার মুখোমুখি হয়েছিলেন ইয়েমেনের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। গত বছরের নভেম্বরে সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর তার ফোন জব্দ করা হয়। পরদিন সৌদি আরবের সরকারি একটি টেলিভিশনে তিনি ইয়েমেনের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন।
সেই সময় ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, সৌদিতে পৌঁছানোর পরদিন বাদশাহ সালমান ও যুবরাজের সঙ্গে দেখা করার জন্য হারিরিকে তলব করা হয়। দেখা করার পর তিনি টেলিভিশনে আকস্মিকভাবে পদত্যাগপত্র পাঠ করেন।
সার্বভৌম একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর লেবাননে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। হারিরিকে জোরপূর্বক পদত্যাগ ও আটকে রাখার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দৃষ্টিকটু এই নাটকের মূলহোতা হিসেবে দেখা হয়।
নারী অধিকারকর্মীদের বন্দি :
চলতি বছরের শুরুর দিকে কট্টরপন্থী সৌদি আরব প্রথমবারের মতো নারীদের গাড়ি চালানো অনুমতি দেয়। দেশটিতে নারী অধিকারের সুরক্ষায় নেয়া বেশ কিছু পদক্ষেপের একটি ছিল এটি। এ সিদ্ধান্তের পেছনে যুবরাজ মূল ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এর নেপথ্যে ১৯৯০ সাল থেকে লড়াই চালিয়ে আসছিলেন দেশটির একদল নারী মানবাধিকার কর্মী।
নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে নারীদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন পুরুষ মানবাধিকার কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়; যারা দীর্ঘদিনের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
রিটজ-কার্ল্টন শুদ্ধি অভিযান :
সালমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে শুধুমাত্র মানবাধিকার কর্মীদের ওপর কঠোর অভিযান পরিচালনা করেননি বরং তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরাও ছাড় পাননি। গত বছর দেশটির কয়েকশ’ ধনী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে নিরাপত্তাবাহিনী। সৌদির দুর্নীতিগ্রস্ত উচ্চপদস্থ আমলাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানোর অংশ হিসেবে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতদের কয়েক সপ্তাহ ধরে রিয়াদের বিলাসবহুল রিটজ-কার্ল্টন হোটেলে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। এসময় এদের অনেকের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানোর অভিযোগ উঠে।
মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে বলছে, বিলাসবহুল এই হোটেলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার অন্তত ১৭ জনকে পরে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরবর্তীতে একজন বন্দি অবস্থায় মারা যান।
উপসাগরীয় সঙ্কটের নেপথ্য নায়ক :
২০১৭ সালের ৫ জুন প্রতিবেশি কাতারের সঙ্গে সৌদি নেতৃত্বাধীন চারটি দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন এবং উপসাগরীয় এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে। কাতারের সঙ্গে স্থলসীমান্ত বন্ধ করে দেয় সৌদি আরব। শুধুমাত্র আকাশ ও সমুদ্র পথ অবরোধের বাইরে রাখা হয়।
কাতারের সঙ্গে সৃষ্ট কূটনৈতিক সঙ্কটের নেপথ্য নায়ক হিসেবে কাজ করে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) ও আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান (এমবিজেড)। কাতারকে একঘরে করে রেখে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদকে বিভক্ত করা ছাড়া তেমন কোনো অর্জন নেই তাদের ঝুলিতে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অবরোধ আরোপের উদ্দেশ্য ছিল কাতারে সৌদি এবং আমিরাতের সামরিক অভিযান পরিচালনা করা। আরব আমিরাতের সেনাবাহিনীর সহায়তায় সৌদি সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে স্থলসীমান্ত পাড়ি দিয়ে কাতারে ঢুকে ১০০ কিলোমিটার দূরের রাজধানী দোহার নিয়ন্ত্রণ নেয়া সৌদি জোটের মূল উদ্দেশ্য।
এক বছরের বেশি সময় ধরে কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি জোটের অবরোধ এখনো বলবৎ আছে। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে এই অবরোধ আরোপ করা হলেও কাতার বরাবরই তা প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
সৌদি আরবে বেড়েছে শিরশ্ছেদ :
গত কয়েক বছরে সৌদি আরবে বেশ কিছু সামাজিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন যুবরাজ এমবিএস। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দেশটিতে প্রথম সিনেমা থিয়েটার চালু এবং কনসার্ট আয়োজনের অনুমতি দেয়া। দেশটিকে উদারবাদী সমাজের দিকে নিয়ে যাবে বলে অনেকেই সৌদি যুবরাজের এ উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন।
কিন্তু একই সময়ে সৌদি আরবে শিরশ্ছেদের ঘটনা বেড়েছে দ্রুতগতিতে। বিশ্বে সৌদি আরবই একমাত্র দেশ যারা এখনো ফাঁসির দণ্ডে অভিযুক্তদের শিরশ্ছেদের আইন জারি রেখেছে। গত এক দশকে শিরশ্ছেদের শীর্ষে অবস্থান করছে সৌদি।
সাংবাদিক জামাল খাশোগির অন্তর্ধান :
সাবেক স্ত্রীকে তালাকের একটি নথি সংগ্রহের জন্য গত ২ অক্টোবর সৌদি সাংবাদিক ও এমবিএসের সমালোচক জামাল খাশোগি ইস্তান্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন। তখন থেকে এখন পর্যন্ত আর তাকে দেখা যায়নি।
সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় হিট স্কোয়াডের সদস্যরা এই সাংবাদিককে কনস্যুলেট ভবনে হত্যা করেছে বলে ধারণা তুরস্কের। তবে সৌদি কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, কনস্যুলেটে প্রবেশের কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে গেছেন খাশোগি।
তখন থেকে সৌদি আরব, তুরস্ক ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য খেলোয়াড়রা দাবার কূটনৈতিক ঘুটি চালাচালিতে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। খাশোগির নিখোঁজের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও আরো বেশ কয়েকটি দেশ তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে সৌদি আরব সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও হুমকি দিয়েছে তারা।
একসময় সৌদি রাজপরিবারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন খাশোগি। কিন্তু যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কার কর্মসূচির সমালোচনা করায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। চলতি বছরের মার্চে আলজাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে খাশোগি বলেছিলেন, আমরা আজ কথা বলতে পারলেও সৌদি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা কারাবন্দী অবস্থায় রয়েছেন।