ইসবগুল হচ্ছে Plantaginaceae পরিবারের Plantago গ্রুপের একটি গুল্ম। এর আদি বাসভূমি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে। এছাড়া স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, পাকিস্তানের সিন্ধু এলাকা, পশ্চিম এশিয়া, চীন, রাশিয়া ও ভারত। এর ফুল ছোট, পাপড়ি সূক্ষ্ম হয়। বীজের খোসা আছে। ইসবগুল গাছ দেড়-দুই ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। ফল দুই কোষবিশিষ্ট। প্রতি কোষ ৭-৮ মিলিমিটার লম্বা হয় এবং ফলের ভেতরে ৩ মিলিমিটার লম্বা বীজ থাকে। বীজ দেখতে নৌকার মতো এবং এর খোসা পিচ্ছিল হয়। এটা এক ধরনের রবিশস্য। হেমন্তকালে বীজ বপন করা হয়। চৈত্র মাসে ফসল তোলা হয়। ইসবগুল মানুষের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। ইসবগুলের ভুসি বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এটি অভ্যন্তরীণ পাচনতন্ত্রের সমস্যার ঘরোয়া চিকিৎসা ও প্রতিকারের জন্য উপকারী।
এবার তাহলে জেনে নিন ইসবগুলের উপকারিতাগুলো—
১. অ্যাসিডিটি প্রতিরোধে : আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু অ্যাসিডিটির সমস্যা থাকে। ইসবগুল হতে পারে এই অবস্থার ঘরোয়া প্রতিকার। ইসবগুল খেলে তা পাকস্থলীর ভেতরের দেয়ালে একটা প্রতিরক্ষামূলক স্তর তৈরি করে যা অ্যাসিডিটির বার্ন থেকে পাকস্থলীকে রক্ষা করে। এছাড়া এটি সঠিক হজমের জন্য এবং পাকস্থলীর বিভিন্ন অ্যাসিড নিঃসরণে সাহায্য করে। ইসবগুল অ্যাসিডিটিতে আক্রান্ত হওয়ার সময়টা কমিয়ে আনে। প্রতিবার খাওয়ার পর দুই চামচ ইসবগুল আধা গ্লাস ঠান্ডা দুধে মিশিয়ে পান করুন। এটি পাকস্থলীতে অত্যধিক অ্যাসিড উৎপাদন কমাতে সাহায্য করে এবং অ্যাসিডিটির মাত্রা কমায়।
২. কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে : ইসবগুলে থাকে কিছু অদ্রবণীয় ও দ্রবণীয় খাদ্য আঁশের চমৎকার সংমিশ্রণ, যা কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য ঘরোয়া উপায় হিসেবে খুব ভালো কাজ করে। পাকস্থলীতে গিয়ে এটি ফুলে ভেতরের সব বর্জ্য পদার্থ বাইরে বের করে দিতে সাহায্য করে। বলা যায়, প্রাকৃতিকভাবে পানিগ্রাহী হওয়ায় পরিপাকতন্ত্র থেকে পানি গ্রহণ করে মলের ঘনত্বকে বাড়িয়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে দুই চামচ ইসবগুল এক গ্লাস কুসুম গরম দুধের সঙ্গে মিশিয়ে পান করে নিন।
৩. ডায়রিয়া প্রতিরোধে : ইসবগুল ডায়রিয়া প্রতিরোধেও সক্ষম। ডায়রিয়া প্রতিরোধে ইসবগুল দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। কারণ দইয়ে থাকা প্রোবায়োটিক পাকস্থলীর ইনফেকশন সারায় এবং ইসবগুল তরল মলকে শক্ত করতে সাহায্য করে, খুব কম সময়ের মধ্যে ডায়রিয়া ভালো করতে পারে। ডায়রিয়া প্রতিরোধে দুই চামচ ইসবগুল তিন চামচ টাটকা দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ার পর খেতে হবে। এভাবে দিনে দুবার খেলে বেশ কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।
৪. ওজন কমাতে : ওজন কমাতে চাইলে ইসবগুল খাওয়া হচ্ছে উত্তম উপায়। এটি খেলে বেশ লম্বা সময় পেট ভরা থাকার অনুভূতি দেয় এবং ফ্যাটি খাবার খাওয়ার ইচ্ছাকে কমায়। কুসুম গরম পানিতে দুই চামচ ইসবগুল ও সামান্য লেবুর রস মিশিয়ে ভাত খাওয়ার ঠিক আগে খেতে হবে। এছাড়া সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে খেলেও তা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
৫. হার্টের সুস্থতায় : ইসবগুলে থাকা খাদ্য আঁশ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে বলে এটি আমাদের হূদরোগ থেকে সুরক্ষিত রাখে। হূদরোগের সুস্থতায় ইসবগুল সাহায্য করে; কারণ এটি উচ্চ আঁশসমৃদ্ধ এবং কম ক্যালরিযুক্ত। চিকিৎসকরা সব সময় হূদরোগ প্রতিরোধে এমন খাবারের কথাই বলে থাকেন। এটি পাকস্থলীর দেয়ালে একটা পাতলা স্তরের সৃষ্টি করে; ফলে তা খাদ্য থেকে কোলেস্টেরল শোষণে বাধা দেয়, বিশেষ করে রক্তের সিরাম কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। এ ছাড়া এটি রক্তের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল সরিয়ে দেয় যা থাকলে ধমনিতে ব্লকের সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে তা হূদরোগ এবং করনারি হার্ট ডিজিজ থেকে আমাদের রক্ষা করে। তাই হার্ট সুস্থ রাখতে নিয়মিত খাবারের ঠিক পরে বা সকালে ঘুম থেকে উঠেই ইসবগুল খেয়ে নিন।
৬. পাইলস প্রতিরোধে : যাদের পায়ুপথে ফাটল এবং পাইলসের মতো বেদনাদায়ক সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য ইসবগুল খুবই উপকারী। এটি শুধু পেট পরিষ্কার করতেই সাহায্য করে না, মলকে নরম করতে সাহায্য করে অন্ত্রের পানিকে শোষণ করার মাধ্যমে এবং ব্যথামুক্ত অবস্থায় তা দেহ থেকে বের হতেও সাহায্য করে। এটি প্রদাহের ক্ষত সারাতেও সাহায্য করে। তাই প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে দুই চামচ ইসবগুল কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে পান করুন।
৭. ডায়াবেটিস প্রতিরোধে : যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের জন্য ইসবগুল খুবই ভালো। এটি পাকস্থলীতে যখন জেলির মতো একটি পদার্থে রূপ নেয়, তখন তা গ্লুকোজের ভাঙন ও শোষণের গতিকে ধীর করে বলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। খাওয়ার পর নিয়মিত দুধ বা পানির সঙ্গে ইসবগুল মিশিয়ে পান করুন ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে। তবে দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাবেন না। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে।
৮. যৌনতা বাড়াতে : প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক গ্লাস ইসবগুলের ভুসির শরবত খেলে যৌনতা বৃদ্ধি পায়।
খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা :
১. ডায়াবেটিক রোগীদের ইসবগুলের ভুসি অবশ্যই চিনি ছাড়া খেতে হবে।
২. অ্যালার্জি রোগীরা, যারা এটি সহ্য করতে পারেন না, তাদের না খাওয়াই ভালো।
৩. নিম্ন রক্তচাপের রোগীদের ইসবগুলের ভুসি না খাওয়াই উত্তম।
৪. কিডনি রোগীদেরও ইসবগুলের ভুসি না খাওয়াই উত্তম।
কেনার সময় সতর্কতা :
ইসবগুল আমাদের দেশে বাজার থেকে শুরু করে সুপার মার্কেট সব জায়গাতেই বেশ সহজলভ্য। তবে কেনার আগে কিছু ব্যাপারে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। যেমন- ১. প্যাকেটজাত ইসবগুল কিনুন। কখনোই খোলা ইসবগুল কিনবেন না। সেগুলো নষ্ট বা ভেজাল মিশ্রিত হতে পারে। যার ফলে এটি খেয়ে ভালো ফল নাও পেতে পারেন। ২. আজকাল প্যাকেটজাত বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম স্বাদের ইসবগুল পাওয়া যায়। তবে ভালো ফল পেতে হলে এসব কৃত্রিম স্বাদের ইসবগুল না খেয়ে সাধারণ ইসবগুল খান। ৩. বিভিন্ন দোকানে সাধারণ ইসবগুলে কৃত্রিম স্বাদ ও রঙ যোগ করে বিশেষ কার্যকারিতার কথা বলে তা বিক্রি করা হয়, যা মূলত স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই সাধারণ ইসবগুল খাওয়াই উত্তম।