আজকাল কবিতা পাঠকের কাঠগড়ায় অভিযোগ কবিতা দুর্বোধ্য। দুর্ববোধ্যতার কারণ কবিতায় ছন্দ নেই, অন্তমিল নেই, ধ্বনি নেই এবং এতসব অনুসঙ্গের সমন্বয়ে আজকের কবিতায় কোনো ঝঙ্কার নেই। শুধু তাই নয় আজকের কবিতা আর খবরের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। খবরের কাগজ ছিড়ে দুফালা করলেই আধুনিক কবিতা হয়ে যায়। এমনি হাজারো অভিযোগের ধকল সইতে না পেরে কবিতা আজ পাঠক বিমুখ। কবিতা তার লাবণ্য নিয়ে পাঠকের দুয়ারে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। হালের পাঠকও কেমন যেন শ্রম বিমুখ। তাই কষ্ট করে কবিতার সৌন্দর্যকে খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করে না। এতসব অভিযোগের ভিড়ে কখনো যদি কোনো কবিতার গা ফুড়ে কিছু আলোর কণা বিচ্ছ্বুরিত হয় তাও সেভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। অযত্ন, অবহেলা আর উপেক্ষার গ্লানি নিয়ে তা হয়তো পাঠকের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়। দুত্যিময়তা নিয়ে সে পৌঁছতে পারে না পাঠকের দৃষ্টিতে। মেকি আলোর ছটার ভিড়ে সেই দ্যুতি হারিয়ে যায়। কথাগুলো প্রাসঙ্গিক এহসানুল ইয়াসিনের ‘উত্তরাধিকারে হলফনামা’ প্রসঙ্গে।
শাদামাটা দুপৃষ্ঠার মলাটের ভিড়ে কবিতাগুলো যেন ঘুমিয়ে আছে কিংবা মুখ ফিরিয়ে আছে পাঠকের উপেক্ষা সইতে না পেরে। ‘উত্তরাধিকারের হলফনামা’ তার দুই মলাটের ভেতর ২৪টি কবিতা বন্দী করেছে। এরমধ্যে আটটি কবিতায় ‘মা’ অনত্যম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। নানা উপলব্ধি আর অনুভূতিতে মায়ের অনুষঙ্গ কবিতায় স্বতন্ত্র এক ব্যঞ্জণা প্রকাশ করতে পেরেছে। কবিতায় ‘মা’ কেবল বিচ্ছিন্ন কোনো অনুষঙ্গ হিসেবে ভূমিকা রাখেনি, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে মানুষের আন্তঃসম্পর্কের মধ্য দিয়ে তার ভেতর জীবন ও পরিবেশ সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে তার বার্তা কবিতায় নানা ভাবে এসেছে মায়ের অনুষঙ্গে। যেমন-
দাঁড় কাকের ডাক শুনলেই দাদু অস্থির হয়ে উঠতেন। আর মাকে বলতেন- ভাত ছিটিয়ে দিতে।
তাঁর বিশ্বাস মানুষের অমঙ্গলের খবর পশুপাখিই প্রথম পায়।
(দাঁড় কাক ও আমাদের গল্প, পৃষ্ঠা-১৩)
এখানে পরিবেশ থেকে, দীর্ঘ সময়ের পাঠ থেকে মানুষ যে জ্ঞান লাভ করে, তাই তাদের বিশ্বাসে পরিণত হয়। দীর্ঘদিনের বিশ্বাস এক সময় মানুষের সংস্কৃতিতে রূপ লাভ করে। ফলে গ্রামীণ মানুষের আবহমান সংস্কৃতির বার্তা সকল স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এহসানুল ইয়াসিন কবিতাকে বেছে নিয়েছেন। তাই অন্য কবিতায় দেখিÑ
মা বলতেন- লাল নীল রঙে সবার আগ্রহ থাকে না যতটা থাকে কালো রঙের উৎসবে।
তিনি বলতেন-
বেওয়ারিশ লাশের মিছিল দেখো শত্রু-মিত্র সবাই এখানে আসে।
এমনকি অনেক অজানা অচেনা মুখও।
(উৎসবের রং কালো নয় কেন?,পৃষ্ঠা-১২)
প্রকৃতি থেকে জারিত রসদ নিয়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের পর মানবিক সত্তায় যে বিশ্বাস গড়ে ওঠে তার এক নিবিড় ব্যাঞ্জনা ইয়াসিন তার কবিতায় তুলে ধরেছেন ভীষণ শিল্পিত হাতে। এবং প্রকৃতি মানুষ অনুষঙ্গ হিসেবে যখন একে অন্যের অস্তিত্বের ভেতরে বিলীন হয়ে যায়, তখন তার মিলিত রসায়ন কবি সত্তায় মঞ্জুরিত হয়ে কত কাব্যিক হতে পারে, প্রকৃতি ও মানুষের যৌথ প্রতিকৃতি কত লাবণ্যময় হতে পারে তা এহসানুল ইয়াসিনের কবিতায় ধরা দিয়েছে অত্যন্ত সার্থকভাবে-
আমার জন্মের বছর মায়ের শরীরে নাকি লেবু ফুলের সুবাস জড়িয়ে থাকতো কেউ কেউ মাকে বলতো- আমি নাকি খুব সৌভাগ্য বয়ে আনবো।
যেদিন আমার জন্ম হলো একজোড়া ভাতশালিক ঘরের পাশে গান ধরেছিল যে ডাহুক সন্তান প্রত্যাশী হয়ে সারারাত রক্ত ঝরানোর কান্নায় কেঁদেছিল সেও নাকি আমার জন্ম আনন্দে উৎসব করেছিল। আর আমার মা- ডালিম গাছের ডালের উপর বসা কাকগুলোর জন্য ছুড়ে দিয়েছিল তাঁর স্নেহ।
(আমার জন্মের বছর, পৃষ্ঠা-১৪)
অনুষঙ্গ হিসেবে শুধু ‘মা’ নয় বাবাকেও উপস্থাপিত করেছেন কবি তার কোনো কোনো কবিতায়। যেমন-
বাবা অবশ্য আগুন দেখলে শতবর্ষী বটগাছের কথা বলতেন। আর বলতেন- নদীগর্ভে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র বটগাছটি তারই পূর্বপুরুষের চিহ্ন বহন করে চলেছে। এখনো বাতাসে সতর্ক নাক রাখলে তাদের শরীরের গন্ধ পান!
(বটগাছ, আগুন ও আইসক্রিম রহস্য, পৃষ্ঠা-২৫)
অর্থাৎ ইয়াসিনের কবিতা পর্যালোচনা করলে বলা যায়, কবি এখানে ‘বাবা’ ‘মায়ের’ অনুষঙ্গে চিরন্তন কিংবা দীর্ঘকাল ধরে প্রবহমান যে বার্তাটি পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেছে তা আসলে আমাদের সমাজে, সংস্কারে, বিশ্বাসে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার যে জ্ঞান, যা পুরুষ থেকে পুরুষান্তরে, বংশ থেকে বংশপরম্পরায়, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে টিকে আছে, মানুষের মধ্যে তাকে তিনি নাগরিক জীবনে, নাগরিক বিশ্বাসেও ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন কবিতার আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। কারণ আমাদের নাগরিক সমাজের অধিকাংশ মানুষেরই শেকড় গ্রামীণ জীবনে। কেউ এক পুরুষ আগে কেউ দুই পুরুষ আগে কেবল নাগরিক আলোকবর্তিতায় নিজের অবয়ব দেখেছেন। কিন্তু আধুনিকতার পশ্চিমা বাতাসে সে মানুষগুলো নিজের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন, সেই শেকড় ছিন্ন, ভূইফোঁড় মানুষের মধ্যে তার শেকড়ের অস্তিত্ব মনে করিয়ে দেবার সচেতন প্রয়াস আমরা লক্ষ করি ‘উত্তরাধিকারের হলফনামা’ র বেশ কিছু কবিতায়।
চিত্রকল্প নির্মাণে এবং উপমা প্রয়োগে যথেষ্ঠ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন এহসানুল ইয়াসিন। জীবন ও প্রকৃতি থেকে নিরন্তর পাঠ গ্রহণের এক সংবেদনশীল মন যে ইয়াসিন আতস্থ করেছেন তা তার চিত্রকল্প ও উপমা প্রয়োগ থেকেই বোঝা যায়। উপমা প্রয়োগের সার্থক কিছু লাইন এখানে পাঠকের জন্যে উপহার দেয়া যায়। যেমন-
ক. সুন্দরী রমণীরা দাঁত বের করে হাসছে। যেন নির্বাচনের হরিলুটের টাকার মতো সে হাসি।
(উৎসবের রং কালো নয় কেন?,পৃষ্ঠা-১২)
খ. সব কিছুই তেড়ে আসছে উদ্ভট বিজ্ঞাপনের মতো
(বৃষ্টি! আহা বৃষ্টি!, পৃষ্ঠা-৪০)
গ. সদর রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ প্রেমিকা, পরনে তাঁর হলুদ হতাশা!
(বাড়ি ফিরবো বলেই বাইরে আসা, পৃষ্ঠা-৩৪)
ঘ. আমি অশ্বের গতি নিয়ে হাঁটতে থাকি গাঢ় অন্ধকারে মাছের চোখের মতো চোখ মেলে ঘুমিয়ে যাই।
(দহনকালের পিশাচদের কথা, পৃষ্ঠা-৩০)
ঙ. বাঁদুরঝোলা হয়ে তারে ঝুলছে কাক ও মানুষের দীর্ঘশ্বাস!
(কাক ও আমি. পৃষ্ঠা-১৮)
চ. রাজপথে মানুষের দীর্ঘ লাইন থাকে না থাকে কেবল দীর্ঘশ্বাস আর শূন্যতা।
(সপ্রাণ ভিক্ষুক, পৃষ্ঠা-১৯)
ছ. হাঙরের মতো কতোদিন উপোস থেকে গা ঢাকা দিয়ে আছে নগরীর উঠতি মাস্তান
(বৃষ্টি! আহা বৃষ্টি!, পৃষ্ঠা-৪০)
জ. আমি কেবল নিঃসন্তান পিতার মতো শূন্যতা দিয়ে সবকিছু বোঝার ভান করছি।
(পশুবলিতে আনন্দ নেই!, পৃষ্ঠা-২২)
চিত্রকল্প নির্মাণে ইয়াসিন কতোটা স্বতন্ত্র কণ্ঠের শিল্পী, কবিতা আবাদে কতখানি পুরশ্রমী তিনি, তা তার কবিতায় মনোযোগ দিলেই বোঝা যায়। যেমন-
ক. অবেলায় বাড়ি ফিরতে চাইলে হাই তোলে এ শহর ক্লান্ত বাসের ভাঙা হেডলাইট ভেঙচি কাটে।
(ধুলোচিন্তা, পৃষ্ঠা-২১) খ. কেবল সবকিছু ঝুলে থাকে স্বৈরাচারী প্রেমিকের হাতে নিহত হয় গণতন্ত্র নস্যাতের গর্তে পড়ে হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকে জারজভ্রুণের চিহ্ন!
(রাত দীর্ঘ হলে যৌনগন্ধী হয়ে ওঠে এই শহর, পৃষ্ঠা-১৭)
গ. অথচ আদিপিতার প্রার্থনালগ্নে তাদের করতলে পাঠিয়েছি বিশুদ্ধ বাতাসের তারবার্তা। (কাক ও আমি. পৃষ্ঠা-১৮)
ঘ. মা রোজ রোজ বলে-
ট্রেন হচ্ছে মানুষের মতো স্বার্থপর ট্রেনকে উপেক্ষা করিস না।
(স্টেশনে বসে লেখা, পৃষ্ঠা-২০)
ঙ. আমাকে দেখে চোখ রাঙায় জলপাই রঙের জিপ কিংবা মুচকি হাসে তালতলা থেকে আসা গুলিস্তানগামী ক্লান্ত বাস।
(বাড়ি ফিরবো বলেই বাইরে আসা, পৃষ্ঠা-৩৪)
চ. জেগে ওঠে কুয়াশা মাড়ানো ভুলপথ। কিংবা মুসলেম মিয়ার দাগপড়া হলুদ দাঁত।
(অবসরের গান কিংবা প্রাচীন গল্পগাথা, পৃষ্ঠা-২৬)
অর্থাৎ ওপরের উদ্বৃত কবিতার লাইনগুলো বিশ্লেষণ করলে একথা অনায়াসেই বলা যায়। ইয়াসিন তার কবিতায় যে উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহার করেছে, তা তার জীবনের গভীর থেকে উৎসারিত। একজন কবি তার কবিতায় প্রকাশিত হবার অনেক আগে থেকেই তার মননের চর্চায় ব্রতী হন। হন বলেই আশপাশের রমণীদের হাসি থেকে শুরু করে মুসলেমদের দাগ পড়া হলুদ দাত কোনো কিছুই তাদের দৃষ্টি এড়ায় না। বাদুরের ঝুলে থাকার সঙ্গে দীর্ঘশ্বাসের ঝুলে থাকার তুলনা কেবল গভীর সংবেদনশীল মন থেকেই উৎসারিত হতে পারে। অর্তাৎ যে মন গৃহী সত্তার বাএির ঋষিসত্তা কিংবা বৈরাগী সত্তাকে লালন করে হৃদয়ের নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে তার আশপাশ, তার যাপিত জীবন, প্রকৃতি ও মানুষ সবকিছু থেকেই রসদ গ্রহণে অভ্যস্ত তিনিই কেবল পারেন উপমা প্রয়োগে কিংবা চিত্রকল্পনির্মাণে অপ্রচল দৃশ্যকে মুঠোবন্দি করতে। যা পাঠ করলে খানিক সময়ের জন্যে হলেও পাঠক কিংকর্তব্যবিমূঢ় না হয়ে পারে না। কবিতাকে দুর্বোধ্যতার আড়ালে না ঢেকে বিনম্র এক রহস্যময়তায় মেখে তাকে পাঠকের কাছে পৌছে দেবার প্রয়াস ইয়াসিনের কবি চিত্তে বিরাজমান। তার সফলতা কামনা করছি অন্তরের অন্তস্থল থেকে।
বইয়ের নাম : উত্তরাধিকারের হলফনামা, লেখক : এহসানুল ইয়াসিন, ধরন : কবিতা, প্রকাশনায় : মত ও পথ