রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশের সবার নজর আটকে আছে সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অনুষ্ঠেয় সংলাপের দিকে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বহুল প্রত্যাশিত এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
জানা যায়, সংলাপের নেতৃত্ব দেবেন সরকারি দলের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে ড. কামাল হোসেন । এতে ঐক্যফ্রন্টের আরো ১৫ সদস্যের নাম চূড়ান্ত করা হলেও আওয়ামী লীগের পক্ষে কারা থাকছেন তা এখনো জানা যায়নি। তবে বিএনপি মহাসচিবসহ পাঁচ সদস্য উপস্থিত থাকছেন।
সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের আলোচনায় তাদের দেওয়া ৭ দফাই প্রাধান্য পাবে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে ড. কামাল হোসেনকে দেওয়া চিঠিতে সংবিধানের মধ্য থেকে আলোচনার কথা বলেছেন।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা ৫ বছর বাড়ানোর ফলে এই সংলাপের সফলতা নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে সংশয় দেখা দেয়। বিশেষ করে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে এ বিষয়ে নেতিবাচক আলোচনা চলে। তাঁদের অনেকেই মনে করেন, হঠাৎ করে সংলাপের আহ্বান স্রেফ বিএনপিকে ফাঁদে ফেলার জন্য।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানোর জন্যও এটি করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার সাজা বাড়ানোর পর তাত্ক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এতে সংলাপের ফল নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগ কতটুকু আন্তরিক তাও জনগণ বুঝতে পারছে।
বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতারাও মনে করেন, সোমবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাজা এবং পরদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা বাড়ানোর ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। তাঁদের মতে, বিএনপিকে চাপে রেখে সংলাপ করা শুধু আইওয়াশ। জানা যায়, বিষয়টি নিয়ে গতকাল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত নেতারা বলেছেন, এ বিষয়ে সরকারের কূটকৌশল তথা তৎপরতার দিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু তার পরও সংলাপে যাওয়ার পক্ষে সবাই মত দেন।
জানা যায়, ঐক্যফ্রন্টের একটি দলের পক্ষ থেকে সংলাপে যাওয়ার আগে খোলা মনে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আরেকটি চিঠি দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু তাতে সংলাপের উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, পাশাপাশি জনমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে—এমন বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত সংলাপে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। নেতারা মনে করেন, সংলাপ ভণ্ডুল হয় এমন দায় বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ বিদেশিদের চোখে দায় তাতে ঐক্যফ্রন্টের ওপর পড়বে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের আলোচনার ভিত্তি হবে ৭ দফা। তবে খালেদা জিয়ার নতুন করে সাজা ও সাজা বাড়ানো প্রসঙ্গে মওদুদ আহমদ বলেন, আপাতত আমাদের সহ্য করে যেতে হবে। আমাদের কারণে সংলাপ ভণ্ডুল হোক সে রকম ফাঁদে আমরা পড়তে চাই না। তিনি বলেন, তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী একটু নমনীয় হলে দেশে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন সম্ভব।
যুক্তফ্রন্টের ৭টি দাবি হচ্ছে—সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠন, খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার নিশ্চিত করা, যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালো আইন বাতিল, নির্বাচনের ১০ দিন আগে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন, দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা এবং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও নতুন কোনো মামলা না দেওয়া।
জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের তালিকা মঙ্গলবার রাতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় মোস্তফা মহসিন মন্টুকে।
ঐক্যফ্রন্টকে প্রধানমন্ত্রীর চিঠি :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ঐক্যফ্রন্টের চিঠির জবাব দিয়েছেন। ড. কামাল হোসেনকে লেখা চিঠিতে তিনি আগামীকাল ১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় গণভবনে সংলাপের জন্য ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেখেন, জনাব সালাম ও শুভেচ্ছা নিবেন। আপনার ২৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখের পত্রের জন্য ধন্যবাদ। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সংবিধানসম্মত সকল বিষয়ে আলোচনার জন্য আমার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত। তাই, আলোচনার জন্য আপনি যে সময় চেয়েছেন, সে পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ০১ নভেম্বর ২০১৮ তারিখ সন্ধ্যা ০৭-০০টায় আপনাদের আমি গণভবনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
গতকাল সকাল পৌনে ৮টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর এই দাওয়াতের চিঠি নিয়ে কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় যান আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ। এ সময় সেখানে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, সরকার সংশ্লিষ্টরাই ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগের দলে প্রাধান্য পাবেন বলে জানা গেছে। মন্ত্রিসভার সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে এই দলের সদস্যদের বাছাই করা হবে। দলের সভাপতিমণ্ডলী ও উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন এমন নেতারা এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।
এই সংলাপকে ব্যতিক্রমধর্মী উল্লেখ করে সড়ক ওবায়দুল কাদের বলেন, অতীতে কখনোই শেখ হাসিনার সঙ্গে কারো সংলাপ হয়নি। কাজেই এখন যে সংলাপ হচ্ছে, এটি একেবারেই ‘অ্যাক্সেপশনাল’।
ঐক্যফ্রন্টের দাবির ব্যাপারে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় উনারা বিদেশি পর্যবেক্ষক চেয়েছেন, এতে আমাদেরও আপত্তি নাই। তবে এটা ইসির বিষয়। আপনারা বিশ্বাস রাখুন, আস্থা রাখুন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁদের ডেকেছেন। ড. কামাল প্রস্তাব দিয়েছেন, সে কারণেই তাঁদের ডাকা হয়েছে।