টাইগারদের গৌরবময় ইনিংস ব্যবধানে জয়

ক্রীড়া ডেস্ক

বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরুর পর থেকে এমন একটি দিনেরই স্বপ্ন দেখে এসেছিল। ১১২টি টেস্ট খেলে বাংলাদেশ জিতেছে ১২টিতে। কিন্তু টাইগারদের কপালে একটিও ইনিংস ব্যবধানে জয়ের সৌভাগ্য জোটেনি। বরং, একের পর এক ইনিংস ব্যবধানে হারতেই ছিল অভ্যস্ত।

এবার সেই অধরা স্বাদটিও পেয়ে গেলো টাইগাররা। এক সময় যারা ক্রিকেট বিশ্বে নিজেদের একাধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছিল, এক সময় যাদের মনে করা হতো- ক্যারিবীয়দের ক্রিকেট সূর্য বুঝি কখনোই অস্ত যাবে না, সেই দেশটিকেই বাংলাদেশ নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারেরমত ইনিংস ব্যবধানে হারিয়ে রেকর্ড গড়ে ফেললো। ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশের গৌরবম জয়টি এলো ইনিংস ও ১৮৪ রানের ব্যবধানে।

universel cardiac hospital

সে সঙ্গে ক্যারিবীয়দের হোয়াইটওয়াশ করলো বাংলাদেশ। প্রথম টেস্টে ৬৪ রানে জয়ের পর এই টেস্টে ইনিংস ও ১৮৪ রানের বিশাল ব্যবধানে জয়। নিশ্চিত এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সেরা এক সিরিজ হয়ে থাকবে। অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডকে হারানোর চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এই সিরিজ জয়।

এ নিয়ে ক্যারিবীয়দের দ্বিতীয়বার হোয়াইটওয়াশ করলো বাংলাদেশ। এর আগে ২০০৯ সালে ক্যারিবীয়দের মাটিতে ২-০ ব্যবধানে জিতে এসেছিল সাকিবের নেতৃত্বে।

এবার ৯ বছর পর আবারও সেই সাকিবের নেতৃত্বেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ঘরের মাঠে হোয়াইটওয়াশ করলো টাইগাররা।

এ নিয়ে মোট তিনবার প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করতে পারলো বাংলাদেশ।

প্রথম ইনিংসে ৫০৮ রানের পাহাড় গড়ার পর সেই পাহাড়ে চাপা দিতে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল বোলারদের জ্বলে ওঠা। স্পিনিং উইকেট। সেখানে বাংলাদেশের চার স্পিনার এক সঙ্গে জ্বলে উঠবেন সেটাই ছিল প্রত্যাশা। যেমনটা হয়েছিল চট্টগ্রাম টেস্টে। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে চারজনের সবাইকে প্রয়োজন হয়নি। একা সাকিব-মিরাজই ধ্বস নামিয়ে দিলেন। ১১১ রানে অলআউট করে দিলেন ক্যারিবীয়দের। মিরাজ একাই নিলেন ৭ উইকেট। বাকি ৩টি সাকিবের।

৩৯৭ রানের বিশাল লিড। নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম কোনো দলকে ফলোঅন করালো বাংলাদেশ। ৩৯৭ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করতে পারেনি ক্যারিবীয়রা। শুরু থেকেই সাকিব মিরাজের ঘূর্ণিতে দিশেহারা। এই ইনিংসে একা সাকিব আর মিরাজ সফরকারীদের ওপর হামলে পড়েননি। তাইজুল এবং নাঈমও যোগ দিয়েছেন। কাজের কাজটি করে দিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। এই ইনিংসেও তিনি নিলেন ৫ উইকেট। দুই ইনিংস মিলে মিরাজ উইকেট নিলেন ১২ টি। দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অলআউট হলো ২১৩ রানে।

দুর্দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাল ধরেছিলেন শিমরন হেটমায়ার। একের পর এক ৯টি ছক্কা হাঁকিয়ে ৯২ বলে তিনি করেছিলেন ৯৩ রান।

এক পাশে যখন নিয়মিত বিরতিতে উইকেট পড়ছিল, তখন অন্যপ্রান্তে হেটমায়ারের এমন তাণ্ডব খানিকটা চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটার এবং সমর্থকদের কপালে। অবশেষে সেই চিন্তার ভাঁজ থেকে সবাইকে মুক্তি দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। তাকে ছক্কা মারতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে ধরা পড়লেন হেটমায়ার। তার করা ৯৩ রানের মধ্যে ৯টি ছক্কার সঙ্গে বাউন্ডারি ছিল মাত্র একটি।

স্বাগতিক বাংলাদেশের করা ৫০৮ রানের বিশাল রানের নিচে চাপা পড়েই কি তবে পিলে চমকে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের! না হয়, মাত্র ১১১ রানেই অলআউট হয়ে যায় তারা!

৩৯৭ রানের বিশাল লিড। সঙ্গত কারণেই ফলো অন করানোটা বাংলাদেশের জন্য খুবই সহজ একটি কাজ। সেই কাজটিই করলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে এই প্রথম কোনো দলকে ফলোঅনে ফেলে বাংলাদেশ।

ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেও নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানরা। ইনিংসের শুরুতেই সাকিব আল হাসান আর মেহেদী হাসান মিরাজের ঘূর্ণি ফাঁদে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তারা। শুরুতেই হারায় উইকেট।

ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশ দলে কোনো পেসার নেই। চারজন স্পেশালিস্ট স্পিনার। চট্টগ্রাম টেস্টেও ছিলেন তারা চারজন। যদিও চট্টগ্রামে সাফল্য কম বেশি পেয়েছেন সবাই। কিন্তু ঢাকা টেস্টে সাকিব আর মিরাজ যেন কৃপণ হয়ে উঠেছিলেন। প্রথম ইনিংসে ক্যারিবীয়দের ১০ উইকেটের সবগুলোই ভাগ করে নিয়েছিলেন তারা দু’জন। মিরাজ ৭টি, সাকিব ৩টি।

বাকি দু’জন বোলিংই করার খুব একটা সুযোগ পাননি। নাঈম হাসান করেছেন মাত্র ৩ ওভার। তাইজুল ইসলাম করেছেন আরও কম, মাত্র ১ ওভার। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে দিয়েও ১ ওভার বল করিয়েছিলেন অধিনায়ক সাকিব। কিন্তু উইকেট সবই গেলো মিরাজ-সাকিবের পকেটে।

দ্বিতীয় ইনিংসের শুরুতেই উইকেট নিয়ে নেন সাকিব। তার দেখাদেখি মিরাজও নিলেন ১টি। অর্থ্যাৎ ক্যারিবীয়দের প্রথম ১২ উইকেটের সবগুলোই নিয়েছেন মিরাজ (৮টি) এবং সাকিব (৪টি)। অবশেষে এই দু’জনের সাম্রাজ্যে ভাগ বসালেন তাইজুল ইসলাম। ক্যারিবীয়দের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩য় উইকেটটি নেলন তাইজুল ইসলাম। ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি সুনিল আমব্রিসকে।

তাইজুলের ঘূর্ণি এরপরও অব্যাহত ছিল। তার ঘূর্ণিতে বিভ্রান্ত হয়ে এবার ক্যাচ তুললেন রস্টোন চেজ। তাইজুলের বল ড্রাইভ করতে গিয়েই ব্যাটের কানায় লাগিয়ে বসেন চেজ। এক্সট্রা কভারে ক্যাচ উঠে গেলে সেটা ধরেন মুমিনুল হক। ৩ রান করে ফিরলেন রস্টোন।

সাকিব-মিরাজ-তাইজুলের সঙ্গে উইকেট নেয়ার তালিকায় নাম লেখান নাঈম হাসানও। ৩৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে ৩ রান করে আউট হন শেন ডওরিচ। নাঈম হাসানের বলে সৌম্য সরকারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। ২৯ রানে পড়ে ৪ উইকেট।এক সময় ৪২ রানের জুটি গড়েন কেমার রোচ আর শেরমন লুইস। অবশেষে লুইসকে এলবিডব্লিউ করে বাংলাদেশকে গৌরবময় ইনিংস ব্যবধানে জয় এনে দেন তাইজুল ইসলাম।

সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ : ৫০৮/১০, ১৫৪ ওভার (মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ১৩৬, সাকিব আল হাসান ৮০, সাদমান ইসলাম ৭৬, লিটন দাস ৫৪, মুমিনুল ২৯, মিঠুন ২৯, তাইজুল ২৬, সৌম্য ১৯, মিরাজ ১৮, মুশফিক ১৪ এবং নাঈম হাসান ১২; ব্র্যাথওয়েট ২/৫৭, কেমার রোচ ২/৬১, ওয়ারিকান ২/৯১, বিশু ২/১০৯)।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ : ১১১/১০, ৩৬.৪ ওভার (হেটমায়ার ৩৯, ডওরিচ ৩৭, হোপ ১০; মেহেদী মিরাজ ৭/৫৮, সাকিব আল হাসান ৩/২৭) ও ২১৩/১০, ৫৯.২ ওভার (হেটমায়ার ৯৩, রোচ ৩৭*, হোপ ২৫, লুইস ২০, বিশু ১২; মিরাজ ৫/৫৯, তাইজুল ৩/৪০, সাকিব ১/৬৫ ও নাঈম হাসান ১/৩৪)।

ফল : বাংলাদেশ এক ইনিংস ও ১৮৪ রানে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : মেহেদী হাসান মিরাজ ।
সিরিজ সেরা : সাকিব আল হাসান।

 

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে