আমার দেখা আনোয়ার হোসেন-ডলি আনোয়ার : মুহাম্মদ সামাদ

১৯৮৩ সালে বইমেলায় আমার প্রথম কবিতার বই বের হয়। প্রথম বই প্রকাশের উত্তেজনায় পৃথিবীর সব তরুণ কবির মতোই আমার চোখেও ঘুম নেই। আমার ভেতরে আনন্দ, উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা। কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদপট আর পেছনে আমার ছবি নিয়ে আমি তখন খুব ভাবছি। অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়েও কেনো জানিনা যা কিছু নতুন; যা কিছু বড়; যা কিছু ভালো; সত্য শুধু তার দিকে আমার ঝোঁক। ১৯৭৯ সালের শেষ থেকে ১৯৮১-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত রচিত ১৫৬ পঙ্ক্তির ছয় পৃষ্ঠার বিদ্রুপাত্মক‘একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো’ কবিতাটির নামানুসারে বইয়ের নাম ঠিক হলো একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটি চিত্রকর্ম বাছাই করা হলো প্রচ্ছদের জন্যে। প্রচ্ছদ করেছিলেন প্রয়াত তরুণ শিল্পী মোরাদজ্জামান মুরাদ।

যা হোক, এখন আমার নিজের ছবি উঠানোর পালা। সে সময় এলোমেলো চুল আর দাঁড়িঅলা একজন চিত্রগ্রাহক দেশ-বিদেশে পুরস্কার পাচ্ছিলেন। তার তোলা ও পুরস্কৃত সব অনুপম আলোকচিত্র আর তার নিজের প্রতিকৃতি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছিল। নাম আনোয়ার হোসেন। এরই মধ্যে সূর্য দীঘল বাড়ী ছায়াছবির চিত্রগ্রাহক হিসেবে তিনি জাতীয় পুরস্কার পেলেন; আর শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেলেন তার স্ত্রী ডলি আনোয়ার। আমি স্থির করলাম আমার চেহারা যত ভাঙাচোরাই হোক, বইয়ের জন্যে ছবি আমি এই বিখ্যাত চিত্রগ্রাহককে দিয়েই ওঠাবো। আমি ওই দাঁড়িঅলা আলোকচিত্রিকে ধরার ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত। মাস্টার্সের রেজাল্ট হলেও তখনো সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে থাকি। হলে হঠাৎ রটে গেলো আমার দুইব্যাচ ওপরের ছাত্র আবদুর রহীম খান আমাদের রহীম ভাই ডলি আনোয়ারের ছোটবোন ইতি ইব্রাহীমকে বিয়ে করেছেন। আমি তো মহাখুশি… ইউরেকা, ইউরেকা!

অগ্রজপ্রতীম রহীম ভাইয়ের ক্লাসনোট নিয়ে পড়াশোনায় উপকৃত হয়েছি, টাকা কর্জ নিয়ে দেরীতে দিয়েছি, তার গাটের পয়সায় কত আহার করেছি; আহা, সেই রহীম ভাই বিয়ে করেছেন সিনেমার নায়িকা ডলি আনোয়ারের ছোটবোনকে। আমার মনে তখন ছোটবেলার সিনেমা দেখার স্মৃতি জেগে ওঠলো। সিনেমার নায়িকা ডলি আনোয়ারের বাসায় যাবো, তাকে দেখবো! সে এক আশ্চর্য্য অনুভূতি। রহীম ভাই তখন ঢাকার বাইরে একটি প্রজেক্টে কাজ করেন আর মাঝে-মধ্যে হলে আসেন। সামর্থের বাইরে হলেও কারো অনুরোধ বা দাবি উপেক্ষা করা রহীম ভাইয়ের স্বভাববিরুদ্ধ; এবং এখনো। আর, আমার দাবি না মানার তো প্রশ্নই ওঠে না। এক সকালে রহীম ভাই আমাকে ডলি আপার জিগাতলার বাসায় নিয়ে গেলেন। ছোটবোনের জামাইকে বাঙালিপনায় খুব খাতির-যত্ন করলেন ডলি আপা। আমি কবিতা লিখি এবং ছবি তোলার জন্যে এসেছি শুনে খুব আগ্রহ করে ভেতর থেকে লুঙ্গিপরা সেই দাঁড়িঅলা আনোয়ার হোসেনকে ডেকে একরকম নির্দেশই দিলেন। আনোয়ার ভাইয়ের পরনে বাটিকের লুঙ্গি। খালি গা। আনোয়ার ভাই আমাকে পরের শুক্রবার আসতে বললেন। আমার অস্থিরতা আর কাটে না। গেলাম পরের শুক্রবারে। ছবি তোলারও নতুন অভিজ্ঞতা হলো। এতদিন জামালপুরে বা ঢাকার স্টুডিওগুলো একশর্টে আমার ছবি তুলেছে। দুটি ক্যামেরা দিয়ে আমার অনেকগুলো ছবি তুললেন আনোয়ার ভাই। তিনদিন পর আবার ছবি আনতে গেলাম। আমার থুতনির নিচে একটি মাটির কবুতর বসিয়ে তোলা একটি মাত্র ছবি দিলেন আমাকে।

বইমেলায় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো বেরোলো। আবার এক সকালে ডলি আপা ও আনোয়ার ভাইকে বই দিতে গেলাম। ফেব্রুয়ারি মাস। আমার যথেষ্ট শীতের কাপড় নেই জেনে খুব আফসোস করলেন ডলি আপা। তারও তখন হাত খালি, ঘর খালি। ছবি তোলার কাজ নিয়ে আনোয়ার ভাই আফ্রিকায় গেছেন। ঘরের সব দামি জিনিস-পত্র বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন ডলি আপা। জানলাম, আনোয়ার ভাইয়ের ছোট ভাই কামালকে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছেলেটি পড়ায় তাকে সারা বছর মাসিক হারে টাকা দেন তিনি। তার যুক্তি, ছাত্রের স্কুল ছুটি থাকলেও শিক্ষকের তো বেতন বন্ধ করা চলে না।

তিন/চার বছর আগে ঢাকার অ্যালিয়ঁস ফ্রঁসেসে কবিতা পড়তে গিয়ে আচমকা আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হলো। প্রায় তিরিশ বছর পর দেখা। বললাম, আনোয়ার ভাই আমাকে চিন্ছেন? পাকা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন আরে সামাদ তোমারে চিনবো না, মাটির কবুতর দিয়া তোমার ছবি তুইল্যা দিছিলাম; মাঝে-মধ্যে তোমার ছবি দেখি; কেমন আছো? ঘাড়ে-পিঠে হাত দিয়ে স্নেহের পরশ ছড়িয়ে দিলেন। এখন কোথায় আছেন জিগ্যেস করতেই জানালেন প্যারিসে থাকেন; মাঝে-মধ্যে দেশে আসেন।

জনান্তিকে বলি, খুব ছোটোবেলা থেকেই আমার সিনেমা দেখার নেশা ছিলো দুর্দান্ত। সিনেমা দেখে দুইআনা দামের একটি খাতায় আমি ছবির নাম লিখে রাখতাম। ১৯৭৬ সালের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার আগ পর্যন্ত আমি সাড়ে চারশ’র মতো ছবি দেখেছি। ঢাকায় এসেও বেশকিছু ভালো ছবি দেখার সুযোগ হয় আমার। যেমন, সোফিয়া লরেন অভিনীত সান ফ্লাওয়ার, সেনেগালের কাহিনী নিয়ে বিখ্যাত ছবি মানি অর্ডার, পিটার ব্রুকের মহাভারত আর ডলি আনোয়ার অভিনীত সূর্য দীঘল বাড়ী। বিশেষ করে সূর্য দীঘল বাড়ী ছবির কয়লার ইঞ্জিনচালিত ঝিকঝিক রেলগাড়ি একদিকে যেমন আমার শৈশব আর বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অপু-দূর্গাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, তেমনি মাটির উনুনে ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে ছেলের খোঁজে বের হওয়া জয়গুনের মধ্যে আমি বাৎসল্যকাতর আমার মায়ের চিরায়ত মুখ খুঁজে পেয়েছিলাম। ডলি আনোয়ারের সেই অনবদ্য অভিনয়ে, মাটির উনুনের পাশে বসা আমার মায়ের মুখ আমি কখনো ভুলতে পারি না।

১ ডিসেম্বর বিকেল ৩টার দিকে অনলাইন পত্রিকা দেখে চমকে উঠি! ‘চলে গেলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রশিল্পী আনোয়ার হোসেন’! সারাটা বিকেল বেদনায় বুকের ভিতরটা খা-খা করে। আমার অনুজপ্রতীম কবি তারিক সুজাতের সঙ্গে কথা বলি। তারিক জানায় সম্প্রতি খুব অর্থকষ্টে দিন কাটছিলো আনোয়ার ভাইয়ের। হয়তো কিছুটা হতাশা নিয়ে কাউকে না জানিয়ে অনন্তের পথে যাত্রা করেছেন! ডলি আপাও এভাবেই চলে গেছেন। বিখ্যাত ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। কমনওলেযথ স্বর্ণপদকসহ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন ৬৮টি। এ বয়সে নিজের ও কত মানুষের কত অর্থকষ্ট আমি দেখেছি; এবং দেখছি! তাই, আনোয়ার ভাইয়ের অর্থকষ্টের কথা শুনলে বিচলিত হই না। সারা পৃথিবীর কোন্ গুণী অর্থকষ্টে ছিলেন না, শুনি? আবার আমার হাসিও পায়! চারিদিকে এতো অঢেল অর্থ প্রতিদিন কত অনর্থ ঘটাচ্ছে!

লেখক : কবি ও সভাপতি, জাতীয় কবিতা পরিষদ

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে