গতরাত থেকেই বাংলার শহর-বন্দর, অলিগলি, গ্রামগঞ্জ ও মেঠোপথের পল্লীতে বেজে চলেছে বিজয়ের গান। বাঙালির হৃদয় গহিনে অনুরণিত হচ্ছে সেই সুর। মুখে মুখে ধ্বনিত হচ্ছে ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই/খুশির হাওয়ায় ওই উড়ছে/বাংলার ঘরে ঘরে, মুক্তির আলো ওই ঝরছে।’
কেননা আজ বাঙালির গৌরবের, আনন্দের, অহঙ্কারের, আত্মমর্যাদার ও আত্মোপলব্ধির দিন।
আজ মহান বিজয় দিবস। দেদীপ্যমান, প্রসন্ন, আলোকিত বিজয় দিবস। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসরদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করার দিন।
ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ৪৭ বছর আগে এই দিনে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটেছিল এক নতুন দেশ। বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির জীবনে তাই আজ এক মহা-আনন্দের দিন। এমনই একটি দিনের প্রতীক্ষায় বাঙালির কেটেছে হাজারও বছর।
এবারের বিজয় দিবস বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এ মাসেই নির্ধারিত আছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা ভোট প্রার্থনায় জনগণের কাছে যেতে শুরু করেছেন। গোটা জাতি ভোট দিতে উদগ্রীব, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। এতে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী মুক্তিযোদ্ধাদের জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেন। পাশাপাশি দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বাঙালির বিজয় ছিনিয়ে আনার দিন। সেইদিনে ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী হাতের অস্ত্র সমর্পণ করে। এরপর মাথা নিচু করে দাঁড়ায় অকুতোভয় বীর বাঙালির সামনে। স্বাক্ষর করে পরাজয়-সনদে। এ কারণেই আজকের দিনটি এতটা গৌরবের ও আনন্দের। তবে এই বিজয় অর্জনে যেহেতু এক সাগর রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম দিতে হয়েছে, তাই আনন্দের পাশাপাশি বাঙালির মনে আছে অনেক ব্যথা, কষ্ট।
এ কারণে ৪৮তম বিজয় দিবসে মুক্তির জয়গানে মুখর কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে আজ স্মরণ করবে জাতির সেইসব শ্রেষ্ঠ সন্তান ও অকুতোভয় বীর ও মা-বোনকে। এ সময় অনেকেরই মুখে থাকবে চেতনা শানিত করার গান, ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না/আমি গাইব গাইব, বিজয়েরই গান/ওরা আসবে, চুপি চুপি/যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।’
সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ সারা দেশে স্মৃতির মিনারগুলো আজ শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং ফুলে ফুলে ভরে উঠবে। চিরকৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিয়ে আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে গাইবে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম/সকল শহীদ স্মরণে/আমার হৃদয় রেখে যেতে চায় তাদের স্মৃতির চরণে…।’ পাশাপাশি বিজয়োল্লাসরত মানুষ শপথ নেবে স্বপ্নিল দেশ গড়ার।
এদিকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মিছিলের স্রোত গতরাত থেকেই এগিয়ে চলেছে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পানে। জাতি আজ শ্রদ্ধাবনত হৃদয়ে স্মরণ করছে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নায়ক বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরে তার প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে নতুন করে শপথ নেবেন নতুন প্রজন্মের মানুষ।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারেও শ্রদ্ধা জানাবে লাখো মানুষ। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতকে, যারা সে সময় এক কোটি মানুষকে আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং আর সাহস জুগিয়েছিল। স্মরণ করা হবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ (রাশিয়া) অন্য বন্ধুরাষ্ট্র ও ব্যক্তির অবদানের কথা।
বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ সাধারণ ছুটির দিন। ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়েছে। সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উড়ছে। ঘরে ঘরে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা। সূর্যোদয়ের সময় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্বাধীনতার শহীদদের অমর স্মৃতির প্রতি জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় নেতারাও পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করেন। এরপরই স্মৃতিসৌধে নামে স্বাধীনতাপ্রিয় জনতার ঢল। বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে জাতীয় সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র।
বাংলাদেশ বেতার, বিটিভি, বেসরকারি রেডিও এবং টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। ইতিমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কদ্বীপ প্রধান সরকারি ভবন, প্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। সবমিলিয়ে বর্ণিল বিজয় দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচি : দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, বিজয় শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা, স্বাধীন বাংলা বেতারের ও দেশবরেণ্য শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজন করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- আজ রোববার সূর্যোদয় ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল সাড়ে ছয়টায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন। সাড়ে আটটায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন।
এছাড়া সকাল ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, জিয়ারত, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। টুঙ্গিপাড়ার কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, কাজী জাফর উল্লাহ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক আ. ফ. ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আলহাজ এড. শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, কার্যনির্বাহী সদস্য এসএম কামাল হোসেন প্রমুখ উপস্থিত থাকবেন।
দ্বিতীয় দিন সোমবার মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করবে আওয়ামী লীগ। বিকাল তিনটায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিএনপির কর্মসূচি : কর্মসূচির মধ্যে আছে- আজ সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। সকাল ৮টায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর কর্মীদের নিয়ে শেরেবাংলা নগরে জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন নেতারা। এর আগে বিজয় দিবস উপলক্ষে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ জেলা কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও রাতে কার্যালয়গুলোয় লোকসজ্জা করেছে দলটি।
দলের পক্ষ থেকে আজ সকাল ১০টায় নয়াপল্টনের বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা বের করা হবে। এতে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের শীর্ষ নেতাদের যোগ দেয়ার কথা আছে।
বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচি : মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, ন্যাপ, জাকের পার্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন, কৃষক লীগ, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট : আজ রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সকাল ১০টায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বিজয় শোভাযাত্রা বের করবে। এর উদ্বোধন করবেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখবেন জোটের নেতারা।