হাওরের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে ‘শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও’- এ প্রবচনের সাযুজ্য বহুদিনের।
বছরের প্রায় অর্ধেক সময় হাওরাঞ্চল ভেসে থাকে পানিতে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত জেলার ৪৮ উপজেলার বিস্তীর্ণ এই হাওরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার।
বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই এ অঞ্চল দিয়ে বয়ে চলা শত শত নদী উপচে পড়ে। ভরে যায় শত শত বিল। বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলো গাঁথা পড়ে পানির সুতোয়।
সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩ হাওর নিয়ে এই হাওরাঞ্চল।
এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সর্বোচ্চ ১৩৩, কিশোরগঞ্জ জেলায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২২, নেত্রকোনায় ৮০, সিলেটে ৪৩, হবিগঞ্জে ৩৮, মৌলভীবাজারে ৪ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রয়েছে ৩ হাওর।
বর্ষায় অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা হয় হাওরাঞ্চলে। বৈশাখের শেষ থেকে আশ্বিন-কার্তিকের কিছু সময় পর্যন্ত হাওর জুড়ে থাকে পানি। ভর বর্ষায় চারদিকে এই থই থই পানির মাঝে ছোট ছোট গ্রামগুলোকে ভাসমান দ্বীপের মতো মনে হয়। তখন নৌকা বা ট্রলার ছাড়া পা বাড়াবার উপায় থাকে না। সুদূরে সবুজ পাহাড় দেখে মনে হয় কোথাও যেন হাওরের পানিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
স্বাভাবিক অবস্থায় হাওরের পানি কোথাও ঘোলা কোথাওবা স্বচ্ছ নীল, শান্ত সুবোধ জলবাহিকা। আবার দামাল বাতাসের আসকারা পেলেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে হাওর। উন্মত্ত ঢেউয়ে মেতে ওঠে ধ্বংসে। শুকনো মৌসুমে হাওরের অন্যরূপ। চারদিকে যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। যেন সবুজের পসরা।
শীতে অতিথি পাখিরা উড়ে আসে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে। আর এখন হাওরের মধ্যে বেশ কিছু পাকা রাস্তাও তৈরি হয়েছে। তাই শুকনো মৌসুমে চলাচলে খুব বেশি অসুবিধা হয় না। আমাদের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতেও হাওরের রয়েছে অনন্য অবদান।
হাছন রাজা, উকিল মুন্সী, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের হাত ধরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে হাওরাঞ্চলের সঙ্গীতভাণ্ডার। প্রাচীন আখড়া, মন্দির-মসজিদের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে গৌরবময় অতীতের স্মৃতিচিহ্ন।
বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত ধানের এক-পঞ্চমাংশ আসে এই হাওরাঞ্চল থেকে। এই হাওরে রয়েছে প্রাকৃতিক মাছের বিশাল ভাণ্ডার। হাওরাঞ্চলের হিজল-তমাল বন আকৃষ্ট করে সৌন্দর্যপিপাসুদের।
হাওরের সৌন্দর্যে বিখ্যাত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত পর্যটকরা বিমোহিত হয়েছেন। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখে মুগ্ধ হন। তিনি হাওরকে ‘উড়াল পঙ্খির দেশ’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
হাওরের এই অপরূপ রূপ দেখতে প্রতিবছর ব্যক্তি উদ্যোগে মানুষ ছুটে যায় হাওরাঞ্চলে।
বর্ষায় সেখানে একমাত্র বাহন নৌকা। পর্যটকরা দলবেঁধে হাওরে যায়। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঘুরে বেড়ায় হাওরাঞ্চল। কিন্তু পর্যটনের সমূহ সম্ভাবনার এই হাওরাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে পর্যটকদের জন্য কিছু করা হয়নি।
এখানে সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। এ ক্ষেত্রে হাওরে পর্যটকদের জন্য অবকাঠামো, আবাসন, পথনির্দেশনা, পর্যটক আকর্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকে নজর দরকার।
এর জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনই উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে পারে বলে হাওরবাসী মনে করেন। হাওরের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালালে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের মতো হাওর এলাকাও একদিন দেশি-বিদেশি পর্যটকের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠবে।
নিকলি উপজেলার (কিশোরগঞ্জ) শিংপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হকের সঙ্গে কথা হয় এ ব্যাপারে।
তিনি বলেন, হাওরাঞ্চল যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার নিয়ে বসে আছে, এখানে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠলে নানাভাবে আমরা লাভবান হব। প্রথমত সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে পারে এ খাত থেকে। অন্যদিকে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।