১৪ দলের শরিক দুটি দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মন্ত্রিসভায় জায়গা না পাওয়া ও বিরোধী দল হওয়ার প্রস্তাবে শরিকরা অস্বস্তিতে আছে। মন্ত্রিসভায় স্থান না পেলেও তা নিয়ে খুব বেশি সমালোচনামুখর হবে না শরিকরা। ভবিষ্যতে মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয় কি না, সেদিকেই তারা তাকিয়ে থাকবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ ‘একলা চলো নীতি’ অনুসরণ করছে বলে অভিযোগ ১৪ দলের শরিকদের। দলগুলোর প্রতি আগের মতো আওয়ামী লীগের আর ‘আগ্রহ’ নেই বলেও অভিযোগ কোনো কোনো নেতার। মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পাওয়াসহ আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আলাদা অংশ নেওয়ার ঘোষণাকে ‘একলা চলার নীতি’ হিসেবে বিবেচনা করছে জোটের মিত্ররা। এমনকি জোট থাকলেও ভবিষ্যৎ নির্বাচনে জোটগত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার ‘আভাস’ও পাচ্ছে কোনো কোনো শরিক দল। তাই আলাদা চলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে দলগুলো।
সংসদ নির্বাচনে ১৪ দল জোটগতভাবে অংশ নিলেও গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের বিজয় সমাবেশে তাদের উল্লেখযোগ্য আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ ছিল না। গত সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসন বণ্টন নিয়েও আওয়ামী লীগ দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করার অভিযোগ আছে। এতেও ‘ক্ষুব্ধ’ জোট শরিকরা। আওয়ামী লীগের প্রস্তাব অনুযায়ী জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা নিয়েও শরিক দলগুলোতে ‘অস্বস্তি’ আছে। একই প্রতীকে ভোট করার পর এখন তাদের বিরোধী দলে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। সরকারের চাওয়ামতো বিরোধী দলে গেলে ‘আদর্শিক এ জোটের ঐক্য অটুট থাকবে না’ বলেও তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন।
তবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন নিয়ে দলগুলোতে মতানৈক্যও দেখা দিয়েছে। কয়েকটি দল বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে চাইলেও অন্যান্য দলের নেতারা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করছেন। তারা আওয়ামী লীগকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত না জানালেও সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে মতামত দিচ্ছেন। তাদের বক্তব্যে জোট ও মহাজোটের মধ্যে কোনো ‘দূরত্ব’ সৃষ্টি হয়েছে কি না, সেসবের বিচার-বিশ্লেষণও করছেন অনেক নেতাকর্মী। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছেন।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, সংসদ নির্বাচন শেষে মহাজোট ও ১৪ দলের শরিক দলগুলোকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে আওয়ামী লীগ অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেওয়ার পর কয়েকটি দল ‘নাখোশ’ হয়। উন্নত গণতান্ত্রিক বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংসদে বিরোধী দলগুলো সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করে যে ভূমিকা পালন করে থাকে, তেমন বিরোধী দলের ভূমিকায় শরিক দলগুলোকে দেখতে চায় আওয়ামী লীগ। এ কৌশলের কারণে শরিকদের অনেকটা দূরে রাখছে আওয়ামী লীগ। দলগুলো ‘নাখোশ’ হওয়ায় আগামী ৩০ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের মধ্যে ১৪ দলের শরিক সব দল বিরোধী দলে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কি না, এ প্রশ্নও উঠেছে। এবারের মন্ত্রিসভায় শরিক দল থেকে অন্যবারের মতো কাউকে না রাখা ও মন্ত্রিসভা শতভাগ আওয়ামী লীগের হওয়ার পর থেকে ১৪ দলের সঙ্গে ‘মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব’ বাড়ছে। সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের পর বিজয় সমাবেশে শরিক দলগুলোকে সেভাবে আমন্ত্রণ না জানানোয় আওয়ামী লীগ ‘একলা চলো নীতিতে’ চলছে বলে ভাবছে শরিকরা।
১৪ দলীয় সূত্র জানায়, জোট গঠিত হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের বড় কোনো কর্মসূচি থাকলে এর আগে ১৪ দলের সঙ্গে বৈঠক করা হয়। এবারের নির্বাচনের ১৯ দিন পর ১৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের উদযাপিত সমাবেশে ১৪ দলকে অংশ নিতে সেভাবে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। সমাবেশের আগের দিন ১৪ দলের কয়েক নেতাকে আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে ফোন করা হলেও তা ছিল ‘শ্রোতা’ হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ।
এবারের নির্বাচনের পর ১৪ দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠকও হয়নি আওয়ামী লীগের। নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৪ দলের নেতারা একসঙ্গে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানান। এর বাইরে আর ১৪ দলের কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়নি। তাই আওয়ামী লীগের সমাবেশে যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ হয়নি। ফলে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই সমাবেশে অনুপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, দলগুলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দলীয় ও জোটগত বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শরিক দলের নেতারা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন। দলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে শিগগিরই সরকারের সঙ্গে তারা আলোচনায়ও আগ্রহী। ভোটের পর গত ৩ জানুয়ারি বৈঠক হয়েছিল ১৪ দলের। বৈঠকে সংসদে সরকারি ও বিরোধী জোটে থাকার অবস্থান নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গত রোববার পলিটব্যুরোর সদস্যদের বৈঠক ডেকেছে ওয়ার্কার্স পার্টি। বৈঠকে সংসদ নির্বাচনের বিজয় সুরক্ষায় ১৪ দলের অবস্থান সুরক্ষিত করা ও জাতীয় সংসদে ওয়ার্কার্স পার্টির এ যাবৎকালের অবস্থান বহাল থাকবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ২ ও ৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা ডেকেছে হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। আর ১ ও ২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা ডেকেছে জাসদের (আম্বিয়া) একাংশ।
১৪ দলের শরিক দুটি দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মন্ত্রিসভায় জায়গা না পাওয়া ও বিরোধী দল হওয়ার প্রস্তাবে শরিকরা অস্বস্তিতে আছে। মন্ত্রিসভায় স্থান না পেলেও তা নিয়ে খুব বেশি সমালোচনামুখর হবে না শরিকরা। ভবিষ্যতে মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয় কি না, সেদিকেই তারা তাকিয়ে থাকবে। যদিও পরবর্তী সময়ে মন্ত্রিসভায় যুক্ত হওয়ার আশা করা হলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বক্তৃতা-বিবৃতিতে তেমন সম্ভাবনা দেখছেন না কেউ কেউ।’