অবশেষে খুলল বন্ধ ঘরের অর্গল। অবসান হতে যাচ্ছে ২৮ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার। দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়েছে ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের। আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে। শুধু ছাত্র সংগঠনই নয়, ডাকসু নির্বাচনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের রাজনীতির অঙ্গনেও। সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শীর্ষ রাজনীতিবিদ সবার প্রত্যাশা সুষ্ঠু নির্বাচন। আর প্রায় আড়াই যুগ পর সবার এই প্রত্যাশা পূরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ইতোমধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে হলভিত্তিক খসড়া ভোটার তালিকা। তবে চ‚ড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হবে ফেব্রুয়ারির শেষভাগে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, গত অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি তালিকা তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের সঙ্গে সংযুক্ত ও আবাসিক মিলিয়ে মোট ৩৮ হাজার ৪৯৩ জন শিক্ষার্থীর তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৫০৯ জন নারী শিক্ষার্থী ও পুরুষ শিক্ষার্থী ২৩ হাজার ৯৮৪ জন। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু নির্বাচন না থাকায় এখানে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। আমাদের অনেক কিছুই আবার নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। আমাদের অনেক কাজেই ভুল থাকতে পারে। তবে এই নির্বাচন যখন একাডেমিক সিডিউলে চলে আসবে; তখন অনেক কাজই সহজ হয়ে যাবে। নির্বাচনে কেউ যেন কারো অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে না পারে সে জন্য আমরা ব্যবস্থা নেব মন্তব্য করে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ডাকসু নির্বাচনের সুন্দর একটা ব্যবস্থাপনা আছে। এখানে শিক্ষকদের বিভিন্ন কমিটির নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি। ডাকসু নির্বাচন নিয়েও কারো অনাস্থা বা শঙ্কার কোনো কারণ নেই। এর জন্য আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালে। মূলত ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরের বছর যাত্রা করে ডাকসু। প্রথমে পরোক্ষ হলেও পরে শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে ডাকসু নির্বাচন হয়। ডাকসুর বিধান অনুযায়ী প্রতিবছর নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভোট হয়েছে মাত্র সাত বার। ১৯৯০ সালের ৬ জুলাই ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রতিবারই তা ভেস্তে যায়। ছাত্র সংগঠনগুলোর অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কারণে হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমনকি ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ঢাবির ৫০তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন ইজ মাস্ট। এটা না হলে ভবিষ্যতে নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি হবে।’ ডাকসু নির্বাচনের বরফ গলাতে ২০১২ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন ঢাবির ২৫ জন শিক্ষার্থী। ওই বছর ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও ট্রেজারারকে লিগ্যাল নোটিশ দেন রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই নোটিশের কোনো জবাব দেয়নি। এরপর গত বছরের ৮ এপ্রিল হাই কোর্ট নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করার ব্যর্থতা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে। বিবাদী ছিলেন শিক্ষা সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার ও প্রক্টর। এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গতবছরের ১৭ জানুয়ারি ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়ে দেয় হাই কোর্ট। আর ওই নির্বাচনের সময় যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তার দরকার হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয় রায়ে। অবশেষে ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচনের জট খুলে, যা একটি আশাজাগানিয়া ঘটনা হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক নেতা ও বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ২৮ বছর ধরে শিক্ষার্থীদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টরা দায়ী। দেরিতে হলেও নির্বাচন হচ্ছে; এটি আশার কথা। তবে ডাকসু নির্বাচন যেন ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের মতো রাতের অন্ধকারে ভোট উৎসব না হয়। ভোট যেন পেশিশক্তির না হয়। ডাকসু নির্বাচনে যেন সবাই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। নতুবা কলঙ্কজনক ইতিহাস তৈরি হবে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ২৮ বছরে একবার নয়, প্রতিবছর নির্দিষ্ট তারিখে এই নির্বাচন হবে, এমন একটি ধারা তৈরি প্রয়োজন। এ ছাড়া ভোট হবে সকল একাডেমিক ভবনে। কারণ হলগুলো ক্ষমতাসীনদের দখলে। ফলে ভীতিকর পরিবেশে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে পারবে না।
এদিকে ডাকসু নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছে ছাত্র সংগঠনগুলো। নির্বাচনের জন্য ইতোমধ্যে চারটি সংগঠনের তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বাম জোটদের এক প্যানেল এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা প্যানেলভিত্তিক এই নির্বাচনে অংশ নেবেন। নিজেদের প্রস্তুতির ব্যাপারে ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, ডাকসু নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের প্যানেলের পক্ষে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগ সর্বোচ্চ কাজ করে যাবে। এদিকে নির্বাচনে সহাবস্থান নেই বলে অভিযোগ করেছেন ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি আল মেহেদি তালুকদার। তিনি বলেন, আমরা এখনো ক্যাম্পাসে ঠিকমতো যেতে পারি না।
৪৭ বছরে সাতবার ডাকসু নির্বাচন : স্বাধীনতার পর গত ৪৭ বছরে মাত্র সাতবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে নির্বাচনে আমান উল্লাহ আমান ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন খায়রুল কবির খোকন। এরপর নানা প্রতিশ্রুতিতেই চলে যায় ২৮ বছর। ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সৃষ্টি হয়। মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। এরপর বিভিন্ন সময় ডাকসুর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অসংখ্য প্রতিভাবান নেতা তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে আছেন রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, প্রয়াত কে এম ওবায়দুর রহমান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, শফি আহমেদ, নাজিম কামরান চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব, প্রয়াত আবদুল কুদ্দুস মাখন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারউজ্জামান, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, মুশতাক হোসেন। নেতৃত্ব তৈরির ‘সূতিকাগার’ ডাকসু দীর্ঘদিন কার্যকর না হওয়ায় সুস্থ নেতৃত্বের বিকাশ হচ্ছে না বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শিগগিরই এই বন্ধ্যাত্বের অবসান ঘটছে উল্লেখ করে ঢাবি উপ-উপাচার্য ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, আমাদের সকল প্রস্তুতি প্রায় শেষ। চূড়ান্ত ভোটার তালিকার জন্য খসড়া তালিকা তৈরি হয়েছে। গঠনতন্ত্রে কিছুটা সংশোধন আনা হয়েছে। এবারই প্রথম নির্বাচনের আচরণ বিধি করা হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কোনো আশঙ্কা নেই মন্তব্য করে ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে আমরা দায়িত্ব পালন করছি।
ক্যাম্পাস