বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আজ বসবে বাঙালির প্রাণের বইমেলা। উৎসবের এই মেলার জন্য পুরো এক বছর অপেক্ষা করতে হয় লেখক-কবি-সাহিত্যিক আর বইপ্রেমীরা। মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদের স্মরণে বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির আয়োজনে বিকেল ৩টায় আনুষ্ঠানিকভাবে বইমেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯ এর সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জি সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, বাংলা একাডেমির সচিব আব্দুল মান্নান ইলিয়াছ, নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াছ কাঞ্চন, বিকাশের চিফ মার্কেটিং অফিসার (সিএমও) মীর নওবত আলী প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে জালাল আহমেদ জানান, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রী মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখবেন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ।
বিদেশি অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ এবং মিসরের লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক মোহসেন আল-আরিশি। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করবেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল। স্বাগত ভাষণ প্রদান করবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী।
অংশ নিচ্ছে ৫২৩টি প্রতিষ্ঠান: এবারের বইমেলায় অংশ নিচ্ছে ৫২৩টি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও ১৮০টি লিটল ম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ জানান, এবার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫০টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৯৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৬২০টি ইউনিটসহ মোট ৪৯৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭০টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও বাংলা একাডেমিসহ ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ২৪টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে ১৮০টি লিটলম্যাগকে ১৫৫টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২৫টি স্টলে ২টি করে লিটল ম্যাগাজিনকে স্থান দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্টল পেয়েছে অন্য ১৩০টি প্রতিষ্ঠান।
মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা: বিকেল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেলার উদ্বোধন করার পর মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখবেন। এরপর বইপ্রেমী দর্শনার্থীদের জন্য উš§ুক্ত করে দেয়া হবে বাঙালির প্রাণের মেলা।
ড. জালাল আহমেদ জানান, প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত গ্রন্থমেলা উনুক্ত থাকবে। ছুটির দিনে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে মেলা। আর ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলবে গ্রন্থমেলা।
তিনি আরো জানান, মেলায় প্রতিবারের মতো এবারো ছুটির দিনে সকাল বেলায় শিশুপ্রহর ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর বিকেলে সকলের জন্য উন্মুক্ত। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকছে শিশু কর্নার। সেখানে শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থাও থাকবে।
নতুন সংযোজন হিসেবে যা থাকছে: এবারের বইমেলার নতুন থিম নির্ধারণ করা হয়েছে। এই থিম ধারণ করে বইমেলার একটি পূর্ণাঙ্গ নকশা করা হয়েছে। স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর এই কাজ করেছেন। শিল্পী সব্যসাচী হাজরা ও মেহেদি হক শিশু চত্বর সাজানোর কাজ করেছেন। শিল্পী লিটন কর ‘লেখক বলছি’ মঞ্চ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তথ্যকেন্দ্র ও মোড়ক উন্মোচন মঞ্চের পরিকল্পনা করেছেন। এম এ মারুফ মূলমঞ্চের ডিজাইন করেছেন। পুরো প্রাঙ্গণ সাজানোর ব্যাপারে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছে।
এবার পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে স্বাধীনতাস্তম্ভ ও স্তম্ভের সামনের জলাধার বইমেলার অংশ হয় এবং এটি ইতোমধ্যে সবার প্রশংসা অর্জন করেছে। মূল থিমের ধারণা তুলে ধরার জন্য মেলার উভয় অংশে পাঁচজন ভাষা শহীদ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, বাংলা একাডেমি ও বইমেলা এবং স্বাধীনতাস্তম্ভ এসব বিষয়ে তথ্যসম্বলিত প্ল্যাকার্ড মেলায় স্থাপিত হয়েছে। ফলে গ্রন্থমেলার মূল থিম যেমন প্রতিফলিত হবে তেমনি নবপ্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা মেলায় আরও বেশি করে নিজেদের যুক্ত হতে এবং বায়ান্ন ও একাত্তরের চেনায় ঋদ্ধ হওয়ার সুযোগ পাবে।
মেলার একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান উভয় অংশের মূল প্রবেশপথে বৃহৎ এলইডি মনিটর থাকবে। মেলার ম্যাপ, দিক-নির্দেশনা ও জরুরি তথ্য প্রদর্শিত হবে। ফলে পাঠক-ক্রেতা মেলার বিন্যাস সম্পর্কে প্রথমেই ধারণা পাবেন।
লেখকদের নিজের বই নিয়ে বলার সুযোগ দিতে করা হয়েছে লেখক মঞ্চ। ‘লেখক বলছি’ এবারের বইমেলার নতুন সংযোজন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তর-পূর্ব কোণে প্রতিদিন ৫ জন লেখক এই মঞ্চে বসে তাঁদের বই এবং লেখালেখি নিয়ে কথা বলবেন। প্রত্যেক লেখক ২০ মিনিট করে সময় পাবেন। পাঠকদেরও সরাসরি লেখকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ থাকছে। উদ্বোধনী দিন ছাড়া বাকি ২৭ দিন চলবে এই কার্যক্রম। অংশ নেবেন প্রায় ১৩৫জন লেখক।
শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা লেখালেখি করে সেই ক্ষুদ্র লেখকদের উৎসাহিত করার জন্য এবার বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। শিশু চত্বর বিশেষভাবে সাজানো হবে। শিশুদের জন্য এবারের বই মেলায় করা হয়েছে আলাদা শিশুকর্নার। এতে ৭৫টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এখানে শিশুদের খেলার ব্যবস্থা রয়েছে ও বসে বই পড়ার সুবিধাও থাকছে। পুরো প্রাঙ্গণ নতুনরূপে সেজে উঠবে। শিশুচত্বরে ‘তারুণ্যের বই’ নামে একটি বিষয় যুক্ত হবে। শিশুপ্রহরের দিনগুলোতে ‘তারুণ্যের বই’ ব্যানারে শিশু-কিশোরদের বইপাঠে উৎসাহিত করা হবে।
নামাজের ঘর ও টয়লেট ব্যবস্থা সম্প্রসারিত ও উন্নত করা হয়েছে। মহিলাদের জন্য সম্প্রসারিত নামাজ ঘর থাকবে। স্থায়ী টয়লেট ছাড়া সিটি কর্পোরেশনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ টয়লেট স্থাপিত হবে।
শিশু চত্বরে বাংলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় ব্রেস্টফিডিং কর্ণার থাকবে। একই সঙ্গে পুলিশের পক্ষ থেকে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কাছে আরেকটি ব্র্যাস্টফিডিং কর্ণার থাকবে।
এবারের মেলায় প্রথম বয়স্ক পাঠক ও ক্রেতাদের জন্য মেলায় থাকছে হুইল চেয়ারের সুবিধা। মেলা প্রাঙ্গণে এসে বয়োবৃদ্ধরা এই সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। প্রবীণরা যেন নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে চলাফেরা করে বই কিনতে ও আড্ডা দিতে পারেন, এমনকি বিশ্রামও নিতে পারেন সেই উদ্দেশ্যেই নেয়া হয়েছে এমন উদ্যোগ। স্বেচ্ছাসেবীরা এ কাজে নিয়োজিত থাকবেন।
বইমেলায় নানা দিক থেকে আধুনিকায়নে বিশেষ মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। আয়োজক বাংলা একাডেমি ডিজিটাল তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে মেলায় আসা বইপ্রেমীদের নানা তথ্য সরবরাহ, বই ও স্টল বিষয়ক তথ্য জানানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ডিজিটাল মনিটরে সার্বক্ষণিক প্রদর্শিত হবে নানা তথ্য ও মেলাসংক্রান্ত নির্দেশনা। শুধু তা-ই নয়, দেশের আর্থিক লেনদেন বিষয়ক চলমান সব প্রযুক্তির ব্যবহার করে ক্রেতারা বই কেনার সুযোগ পাবেন। থাকছে জিপিএস সুবিধাও।
কয়েক বছর ধরে মেলা জিপিএসের (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) আওতায় আনার কথা বলা হলেও সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু আয়োজক কর্তৃপক্ষ এবার সে বিষয়ে বদ্ধপরিকর। প্রকাশক এবং পাঠকদের একটি বড় দাবি ছিল, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন পজ মেশিনের মাধ্যমে বই কেনার সুযোগ রাখা। এবার সেটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হবে বলে মেলার একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বইমেলায় থাকবে কঠোর নিরাপত্তা: অমর একুশে বইমেলা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে মাসব্যাপী থাকছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মেলায় যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা এড়াতে মেলা প্রাঙ্গণ ঘিরে থাকবে তিন শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা।
বইমেলার প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, আনসার, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের নিরাপত্তাকর্মীরা।
বইমেলা থাকবে সম্পূর্ণ পলিথিন ও ধূমপানমুক্ত। মেলা প্রাঙ্গণ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়াও মেলার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মিত ধূলিনাশক পানি ছেটানো, ভ্রাম্যমাণ টয়লেট স্থাপন এবং প্রতিদিন মশক নিধনের সার্বিক ব্যবস্থা করা হয়েছে।