টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে বছরের শুরুতেই জনগণকে দেয়া ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নেমেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এরই মধ্যে ইশতেহারের প্রতিশ্রুতির অন্যতম ‘দুর্নীতি’ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব সন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে টিআইয়ের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের এবারকার অবস্থান ১৩তম। আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪তম।
দৃশ্যতই দুর্নীতিতে বাংলাদেশ আরো একধাপ এগিয়েছে। নতুন বছরের প্রথম মাসে কয়েকটি অধিদফতর ও পদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পদবিবরণী পেয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করেছে। এতেই সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নড়েচড়ে বসেছেন তারা। দুর্নীতির বিষয়ে জিরো ট্রলারেন্স নীতি বাস্তবায়নের নমুনা এরই মধ্যে দেখাতে পেরেছে সরকার এমনটাই জানিয়েছেন দলটির সিনিয়র নেতারা।
ইশতেহারে বলা হয়েছে, দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ব্যাধি। পেশিশক্তির ব্যবহার ও অপরাধের শিকড় হচ্ছে দুর্নীতি। যার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে অবক্ষয় বা পচন শুরু হয়। এর ফলে অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি কোনো ক্ষেত্রেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে।
অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনকে কর্ম পরিবেশ ও দক্ষতার দিক থেকে হচ্ছে সরকারযুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা হবে। সে ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় এবং প্রায়োগিক ব্যবহারে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও তদারকি ভবিষ্যতে আরো জোরদার করা হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ জোরদার করা হবে। ঘুষ, অনুপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ক্ষমতায় এসে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন দমন করতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত শুক্রবার বিকেলেও মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনকালে একইসুরে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘দেশে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কোনো অস্তিত্ব রাখা হবে না। নির্বাচনের আগে দেয়া ইশতেহারেও ঘুষ, অনুপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার অঙ্গীকার করেছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তবে দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও আইনের প্রয়োগ মুখ্য হলেও তা বাস্তবায়নে শুধু সরকারের দায় নয়, জনগণেরও দায় রয়েছে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা।’
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুপারিশের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন কার্যালয়ে কতিপয় দুর্নীতিবাজ, স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ দিন দুপুরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কাছে ২৫ দফার একটি সুপারিশ হস্তান্তর করেন দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান। এ সুপারিশে স্বাস্থ্যের ১১টি দুর্নীতির খাতও উল্লেখ করা হয়। এরপর এ সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আরো জানা গেছে, গত সোমবার দেশের ৮টি জেলার দুদকের ১০টি টিম আকস্মিকভাবে সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে অভিযান চালায়। এ সময় চিকিৎসকদের ৬২ শতাংশ অনুপস্থিতি পেয়েছেন তারা। এর মধ্যে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অভিযানকালে জরুরি বিভাগের এক কর্মচারী (স্ট্রেচার বেয়ারার) দায়িত্বরত অবস্থায় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণকালে ধরা পড়েন। পরে দুদকের সুপারিশে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা হয়। দুদকের এই জাল থেকে সরকারি-বেসরকারি কেউই ছাড় পাবেন না বলে জানানো হয়েছে, এমনকি এমপি-মন্ত্রীও না।
এরই মধ্যে সরকারের উচ্চ মহল থেকে এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রীদেরও সাবধান করে বলা হয়েছে, কেউ নজরদারির বাইরের নন। সতর্ক হয়ে কাজ করবেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার সরকারের নতুন মন্ত্রিসভাও। তারা নিজেদের অধীনস্ত সংশ্লিষ্ট অধিদফতর, পরিদফতর ও বিভাগগুলোকে সেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। এ দিকে গত ২৭ জানুয়ারি বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) সারা বিশ্বে একযোগে দুর্নীতির ধারণা সূচক-২০১৫ প্রকাশ করে।
দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের এবারকার অবস্থান ১৩তম। আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪তম। দৃশ্যতই দুর্নীতিতে বাংলাদেশ আরো একধাপ এগিয়েছে।
টিআই দুর্নীতির ০ থেকে ১০০ পর্যন্ত একটি স্কোরও তৈরি করে। তাতে ৪৩ স্কোরকে বিশ্বের গড় স্কোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের স্কোর কখনোই ২৭-এর ওপরে যায়নি। তবে এবার, বাংলাদেশের দুর্নীতির স্কোর ২৫, যা আগের বছরের সমান।
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে এর আগে, ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত, টানা পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৪-এর নীচে কখনো নামতে পারেনি বাংলাদেশ। টিআই-এর দুর্নীতির ধারণা সূচকে ১ নম্বর হলো সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। এরপর নীচের দিকে যত নামা যায়, দুর্নীতি তত কম হয়েছে বলে ধরা হয়।
টিআই-এর এই দুর্নীতির ধারণা সূচক মূলত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম এক্সিউকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট ‘রুল অব ল’ ইনডেক্স, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস এবং গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস রিপোর্ট-এর ওপর ভিত্তি করে এই সূচক তৈরি করে। তাই এ সূচকে খাতওয়ারী দুর্নীতির খবর জানা যায় না। তবে টিআইবি যে ‘খানা জরিপ’ তৈরি করে, তা স্থানীয় ভাবে তৈরি হয়। এর থেকে জানা যায় কোন খাতে কেমন দুর্নীতি হয়। অর্থাৎ এর মাধ্যমে খাতওয়ারী দুর্নীতির খবর জানা যায়।
২০১২ সালের খানা জরিপে জানা যায় যে, যারা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা গ্রহণ করেন তাদের ৬৩ ভাগ ঘুষ দিতে বাধ্য হন বা দুর্নীতির শিকার হন। এ ছাড়া ঐ বছর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয় শ্রম ও অভিবাসন বিভাগ। তারপর পর্যায়ক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভ‚মি প্রশাসন ও বিচারিক সেবা খাত বলা হয়, এই সব খাতে ওই সময়ে মোট ঘুষ আদায় হয় ২১ হাজার ৯৫৫.৬ কোটি টাকা, যা কিনা ২০১১-২০১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের শতকরা ১৩.৬ ভাগ এবং জিডিপির ২.৪ ভাগ। এর আগে ২০১০ সালে খানা জরিপে সেবাখাতের মধ্যে দেশের বিচার বিভাগকে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
দুর্নীতির মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খাতুনের সম্পদ জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই অভিযোগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের স্ত্রী ও মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাসের সম্পদও জব্দ করা হয়েছে। শুধু আবজাল হোসেন কিংবা আফরোজা আব্বাস নয়, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সম্প্রতি লুৎফর রহমান বাদল ও তার স্ত্রী সোমা আলম রহমান এবং বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু ও তার স্ত্রী মাহবুবা সুলতানার সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করেছে দুদক।
গত ২৪ জানুয়ারি দুদকের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে দুর্নীতির অনুসন্ধান বা তদন্তকালে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তি দুদকের আওতায় নিয়ে আসা হবে। দুদক মূলত সকল অভিযোগকারীর সম্পদ জব্দ করবে না, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে, আদালতের নির্দেশ সাপেক্ষে তাদের সবার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে।
অপরাধলব্ধ সম্পত্তির বিষয়ে দুদকের নির্দেশিকায় বলা হয়, দুদক আইন-২০০৪, মানিলন্ডারিং আইন-২০১২ ও ২০১৭ সালের দুদক বিধিমালায় দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান, তদন্ত ও বিচারকালে অপরাধলব্ধ সম্পত্তি জব্দ, ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার বিধান রয়েছে। এ ছাড়া ক্রিমিনাল ল’ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮ ও দুদক আইনে দুর্নীতি মামলার বিচার শেষে যারা দোষী প্রমাণিত হবে, তাদের অপরাধলব্ধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও একই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।
দুদকের তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে (২০০৪-১৮) দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগে মোট ৫ হাজার ২৭টি মামলা করেছে দুদক। এর মধ্যে প্রয় ৭৫০টি বা ১৫ শতাংশ মামলা হয়েছে আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সম্পদ অর্জনের অভিযোগে। অন্যদিকে ২০১৮ সালের এপ্রিল প্রকাশিত দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, দুর্নীতির মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সব মিলিয়ে চলমান অনুসন্ধানের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬৫টি। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, দুদকের অনুসন্ধানের বড় অংশজুড়ে রয়েছে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন বলেছেন, স্বাস্থ্য বিভাগের সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুতই শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে। অপরাধ যার যার নিজস্ব বিষয়। সরকার এতে কাউকে ছাড় দেবে না।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আমাদের ইশতেহারে দুর্নীতি বিষয়ে জিরো ট্রলারেন্স ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার গঠনের পরই আমাদের নেত্রী প্রথমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সুনীতি বাস্তবায়নের জন্য দুর্নীতি দূর করতে হবে। দুর্নীতি নির্মূল করার মাধ্যমে জাতিকে মুক্ত ও রক্ষা করা হবে।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমাদের নেত্রী দুর্নীতির বিষয়ে জিরো ট্রলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তিনি মনেপ্রাণে দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন। তিনি সৎ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন। দুর্নীতির বিষয়ে যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার তিনি নিবেন। এরই মধ্যে তিনি কিছু নমুনাও দেখিয়ে দিয়েছেন। দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত অবস্থানে রয়েছেন।’