নতুন সরকার এসেছে। এই সরকারের অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে বহুগুলো কারণে। এবং সেটা ভিন্নভাবে। আমাদের দেশের সব সেক্টরেই আইনের শাসনের অভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে আর্থিক সেক্টরে আইনের শাসনের যে অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তা পুনরুদ্ধার করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে আমি মনে করি। আমি আগেও বহুবার বলেছি, ব্যাংকগুলোতে আইন বলে কিচ্ছু নেই। বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়নও নেই। একদিকে ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তাগণ ক্রমাগত মন্দ ঋণ সৃষ্টি করে চলেছেন। আবার একই সঙ্গে এমডি’রা মিটিং করে সাফাই গাচ্ছেন। আমি বিষয়টি দেখে অবাক হয়েছি। আমরাও তো একদিন এমডি ছিলাম। আমরা যারা ব্যাংক বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি তারা পেশাজীবী কোনো দলের প্রতিনিধি নই। ব্যাংকাররা কিছুদিন আগে প্রেস কনফারেন্স করে বললেন,‘আমরা ঋণ দিয়েছি। কিন্তু সেই ঋণ মন্দ ঋণ হলে আমরা কি করবো?’ এটা কি কোনো যুক্তি হলো? ব্যাংক কর্মকর্তাদের যেমন ঋণদান করা একটি দায়িত্ব তেমনি সেই ঋণ যথাসময়ে আদায় করাটাই তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এমডি’রা যদি বলেন,ঋণ দেয়ার পর তা মন্দ ঋণে পরিণত হলে আমরা কি করবো তাহলে সেই এমডি’দের থাকার দরকারটা কি? এটা খুবই দুঃখজনক যে ব্যাংকের মতো একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরও রাজনীতির মাঠে নামানো হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান সরকারের শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে বিনীয়োগ বাড়াতে হবে যে কোনো মূল্যে। দু’ভাবে বিনিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে। প্রথমত, অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ আহরণ এবং দ্বিতীয়ত, বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের উদ্যোগ গ্রহণ। স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আভ্যন্তরীণ সম্পদ দিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ জন্য ব্যাংকিং সেক্টরকে শক্তিশালি করতে হবে,যাতে তারা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারিদের প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিতে পারে। বাইরে থেকে বিনিয়োগকারিদের দেশে নিয়ে আসার মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে। আমি মনে করি, বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের এমন একটি পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যেখানে বাইরে থেকে বিনিয়োগ আহরণ করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য বেশ কিছু কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যেই বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে অনেক কিছু করেছে। এর মধ্যে সবার আগে উল্লেখ করতে হয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি। সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইতোমধ্যেই অনেকগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। শিল্পায়ন দ্রুততর করার জন্য এগুলো বিশেষ অবদান রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগকারিরা একই জমি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানি অর্থাৎ শিল্প স্থাপনের মতো সমস্ত উপকরণ একই সঙ্গে পাবেন। আমাদের দেশে শিল্প স্থাপনের জন্য উপযুক্ত জমির প্রাপ্যতা একটি বড় ধরনের সমস্যা। কয়েক বছর আগে জাপানি কয়েকজন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে শিল্প স্থাপনের জন্য এসেও উপযুক্ত জমির অভাব ফিরে যেতে বাধ্য হন। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো স্থাপিত হলে শিল্প স্থাপনের মতো উপযুক্ত জমির অভাব অনেকটাই দূর হবে। সরকার অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের কাজ করে চলেছেন। এটা সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক খাত। আগামী সরকার আমলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো বাস্তবায়নে আরো জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে বিদ্যমান বিনিয়োগ পরিবেশ এবং সুবিধা সম্পর্কে অবহিত করে বিদেশি বিনিয়োগকারিদের এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে হবে। আমরা যদি বিদেশি বিনিয়োগকারিদের এখানে নিয়ে আসতে পারি তাহলে স্থানীয়ভাবে পুঁজি যোগানদানের উপর চাপ কমবে। বিদেশি বিনিয়োগকারিরাও বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশের সুবিধা গ্রহণ করে লাভবান হতে পারবে। বিদেশি বিনিয়োগকারিদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার জন্য সম্ভাব্য অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ তো প্রয়োজন হবেই। পাশাপাশি ব্যুরোক্রেসিকেও সঠিকভাবে সাপোর্ট দিতে হবে। বিশেষ করে বিডা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যারা বিনিয়োগে কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত তাদের সঠিকভাবে কাজ করতে হবে।
আভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু কাজ করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন সাধন করা না গেলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা হবে বলে মনে হয় না। মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী সরকারে থেকেও সম্প্রতি বলেছেন, এখন আর জোড়াতালি দিয়ে ব্যাংক সংস্কার করা যাবে না। আমাদের বড় রকমের সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এই কথাটি যদি সত্যি তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করে থাকে এবং সে অনুযায়ী তারা যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাহলে তো ভালো কথা। যদি সত্যি ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য কার্যকর সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া না হয় তাহলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে দুর্দিন নেমে আসতে পারে।
সরকার যে সব ব্যাপারে জ্ঞানসম্পন্ন হবেন তা নাও হতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক রাজনীতিবিদের কিছু সাধারণ জ্ঞান নিশ্চয়ই থাকতে হবে। আমাদের নিকট প্রতিবেশি দেশ ভারতের লোকসংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। তাদের সেখানে বড় ব্যাংকের সংখ্যা ১৮টি’র মতো। বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই ৬০টির মতো ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে। যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে ফেভার করতে চান তাহলে তাকে একটি ভালো কন্ট্রাক্ট দেন। তাকে রাস্তা-ঘাট বানাতে দেন। চাইলে সরকার কোনো ব্যক্তিকে নানাভাবে সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে কেনো একজনকে সহায়তা করা হবে। ব্যাংক তো সাধারণ মানুষের আমানত নিয়ে কাজ করে। কাজেই ব্যাংক নিয়ে কেনো এই খেলা? জনগণের টাকা নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া কোনো সরকারেরই নয়। জনগণের টাকা রক্ষা করা সরকারের পরিত্র দায়িত্ব।
সরকার সব সময় সংস্থা বা ইন্সটিটিউশনের মাধ্যমে কাজ করে। কারণ কোনো কাজ করার জন্য যে অভিজ্ঞতা এবং কলা-কৌশল প্রয়োজন হয় রাজনীতিবিদদের তা থাকে না। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করেন তারা এ সব ব্যাপারে অভিজ্ঞ হন। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভালো কর্মকর্তা তৈরির জন্য সহায়তা করা। মুদ্রা পাচার বা এ ধরনের অসঙ্গতি দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হচ্ছে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্ট ইউনিটের। আগে আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো সংস্থা ছিল না।
তবে সব থেকে বড় কথা, আবারো বলছি, ঋণ আদায়ে সরকারকে মনোযোগি হতে হবে। তা না হলে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ ব্যাহত হবে। ঋণ আদায় হলে ব্যাংকগুলো এবং সরকার অনেকটা স্বস্তির সঙ্গে কাজ করতে পারবে।
লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর।