১০ হাজার কিলোমিটার নদী খনন করা হবে

সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন

নদী খনন
ফাইল ছবি

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) দেশের ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথের নাব্য বাড়ানোর খসড়া মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে । এর আওতায় ১৭৮টি নদী খনন (ড্রেজিং) করা হবে। সংস্থাটি ২০২৫ সালের মধ্যে এ কর্মযজ্ঞ শেষ করতে চায়।

খসড়া পরিকল্পনায় প্রাধান্য পেয়েছে হাওর, পার্বত্য ও দক্ষিণাঞ্চলের ৮০টি নদ-নদী। এর মধ্যে বরিশাল ও খুলনা বিভাগে রয়েছে অর্ধশত নদী খনন। এ কর্মযজ্ঞে মোট ব্যয় হবে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও এত বিশাল নৌপথ খনন করার মতো সক্ষমতা ও জনবল এই মুহূর্তে সংস্থাটির নেই। এদিকে ড্রেজিং কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে তদারকিও বাড়িয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি নদী খননের আগে ও পরে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে রেকর্ড রাখা বাধ্যতামূলক করে একটি পরিপত্র জারি করেছে। এ পরিপত্রে নদী খননে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে ১৬ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বিআইডব্লিউটিএ আশা করছে, এ বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে। সমুদ্র বন্দরগুলো থেকে নৌপথেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন করা যাবে। পাশাপাশি ফসল উৎপাদনে সেচ সুবিধা ও মাছচাষ অনেকগুন বেড়ে যাবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে।

সংস্থাটির ড্রেজিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সংস্থাটির তিনটি প্রকল্প চলমান আছে। এগুলোর আওতায় তিন হাজার ৩১৫ কিলোমিটার নদী খনন কাজ চলছে। আরও দুটি মেগা প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। শিগগিরই এ দুটি প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৩৯৩ কিলোমিটার খনন শুরু হবে। বাকি নদীগুলো খননে নতুন প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। নতুন-পুরাতন সব প্রকল্পের আওতায় ১০ হাজার ৫০০ কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমডোর এম মোজাম্মেল হক গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারের দুটি পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথমত, ঢাকার চার পাশের নদী বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদী দখল ও দূষণমুক্ত করে চলাচলের উপযোগী করা। দ্বিতীয়ত, ১০ হাজার কিলোমিটার নদী খনন করা। আমরা এ দুটি পরিকল্পনা সামনে রেখে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি।

তিনি বলেন, ঢাকার চার পাশের নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএ এ চার নদীর যেখানে নাব্য সংকট রয়েছে সেখানে খনন, বর্জ্য উত্তোলন, নদীর তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, যেসব স্থানে নদীর প্রশস্ততা কম সেখানে তা বাড়ানো হবে। অপরদিকে আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ১৭৮টি নদীর ১০ হাজার কিলোমিটার খনন করবে বিআইডব্লিউটিএ। পাশাপাশি বন্দরগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়নেও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের সামনে অর্থায়ন, জনবল ও সক্ষমতাসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে সবার সহযোগিতা পেলে তা বাস্তবায়ন করা একেবারে অসম্ভব তা বলা যাবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে দেশে বর্ষাকালে নৌপথের পরিমাণ ছয় হাজার কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে তা কমে দাঁড়ায় চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার কিলোমিটারে।

তারা জানান, গত ১০ বছরে সবমিলিয়ে দেড় হাজার কিলোমিটার নৌপথের নাব্য ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আর আগামী পাঁচ বছরে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করার মতো সক্ষমতা নেই।

এর কারণ প্রসঙ্গে তারা জানান, এসব নদী খননে সংস্থার যে জনবল ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন তা নেই। বর্তমানে সংস্থাটির বহরে ৩৫টি ড্রেজার রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি প্রায়ই নষ্ট থাকে। আরও ৪৫টি ড্রেজার সংগ্রহ করা হচ্ছে। বহরে থাকা ৩৫টি ড্রেজারে প্রয়োজনের তুলনায় ৩০-৪০ শতাংশ জনবল কম রয়েছে। ফলে এসব ড্রেজার দিয়ে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ পলি অপসারণ করা যায় না। অপর দিকে প্রতি বছর নদী রক্ষণাবেক্ষণে এক কোটি থেকে এক কোটি ২০ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করতে হয় সংস্থাটিকে। ফলে বেসরকারি খাতের ড্রেজারের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে।

তারা জানান, প্রতি বছরই নদী রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি নাব্য উন্নয়ন কাজ করতে হবে। ফলে পাঁচ বছরে ১০ হাজার কিলোমিটার নতুন নদী খনন করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। খসড়া কর্মপরিকল্পনায় দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে এক হাজার ৯২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে অভ্যন্তরীণ নৌ-পথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (প্রথম পর্যায়ে ২৪টি নৌপথ খনন) প্রকল্পের আওতায় ২৪টি নদী খননের কাজ চলছে। এর আওতায় দুই হাজার ৪৭০ কিলোমিটার নৌপথ উন্নয়নে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। পাশাপাশি ৫০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২টি নদীর ৬৩৫ কিলোমিটার ও ৯৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মোংলা থেকে চাঁদপুর হয়ে রূপপুর পর্যন্ত নৌপথ খনন কাজ চলছে। বাকি নৌপথ সরকারের এ মেয়াদে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ধরা হয়েছে।

আরও দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় চট্টগ্রাম থেকে আশুগঞ্জ হয়ে বরিশাল পর্যন্ত ৯৬০ কিলোমিটার নৌপথ উন্নয়নে খননকাজ আগামী বছর শুরু হবে। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের মধ্যে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা- এই চার নদীর ৪৯৩ কিলোমিটার খননে চার হাজার ৩৭১ কোটি টাকার প্রকল্প কয়েক মাস আগে অনুমোদন পেয়েছে। এটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন মাস। এ ছাড়া গোমতী নদীর ৯৫ কিলোমিটার খননে ৭৯৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে।

অন্যদিকে জিনাই, ঘাঘট, বংশী ও নাগদা নদী খনন ও বন্যা ব্যবস্থপনায় চার হাজার ৮১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে চলতি বছর থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত।

আরও দেখা গেছে, সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও রাঙ্গামাটি-থেগামুখ পর্যন্ত ২৫২ কিলোমিটার নৌপথ খনন ও পুনরুদ্ধারে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। এসব নদী খননে এক হাজার ৩১৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য তিন জেলার ১২টি নদীর ৭০০ কিলোমিটার খননে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। এ ১২টি নদী খননে চার হাজার কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে। খুলনা বিভাগের ১২টি নদীর ৬৫০ কিলোমিটার খনন, রক্ষণাবেক্ষণ, বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে সাত হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় ধরে ডিপিপি প্রস্তুতের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আর বরিশাল বিভাগের ৩১টি নদী খনন, রক্ষণাবেক্ষণ, বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে ছয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরে আরেকটি ডিপিপি প্রস্তুতে পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। এর বাইরে আগামী অর্থবছরে আরও ৪৭টি নদী খননের জন্য সমীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

নদী ড্রেজিংয়ে স্বচ্ছতা রাখতে ১৬ নির্দেশনা :

সম্প্রতি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় নদী খননে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে ১৬ দফা নির্দেশনা দিয়ে পরিপত্রি জারি করেছে।

নৌপরিবহন সচিব আবদুস সামাদ স্বাক্ষতির পরিপত্রে বলা হয়েছে, নদী খননের পলি কোনোভাবেই নদীতে ফেলা যাবে না। নদী খননের আগে ও খননের পরে যৌথ জরিপ করতে হবে, যাতে নির্ধারিত গভীরতা অর্জিত হয়েছে কি-না তা যাচাই করা যায়। তীর ও ঢাল যথাযথ সংরক্ষণ করে নদীর তলদেশে সুষম খনন করতে হবে। যত্রতত্র খনন করা যাবে না। খননের পলি স্তূপাকারে রাখতে হবে যাতে তা নদীতে ধুয়ে নামতে না পারে। এ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। এ ছাড়া পরিপত্রে নদীর পলি ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে