সৌদিরা যে কারণে পাকিস্তানকে কাছে টানছে

বিশেষ প্রতিনিধি

ফাইল ছবি

এমন এক সময়ে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান পাকিস্তান সফর করলেন, যখন ভারত এবং ইরান উভয়ের সাথেই পাকিস্তানের সম্পর্ক উত্তেজনার পর্যায়ে রয়েছে।

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে এবং পাকিস্তান-ইরান সীমান্ত অঞ্চলে পাকিস্তান-সমর্থিত গ্রুপগুলির হামলায় ৪০-এর বেশি ভারতীয় সেনা এবং ২৭ জন ইরানী সেনা নিহত হবার ঘটনায় পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে একঘরে করে ফেলার ভারতীয় প্রত্যয়ের মাঝেই সৌদি যুবরাজের এই সফর এলো।

সফরকালে সৌদি যুবরাজ পাকিস্তানে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের উপরে হামলার পর নরেন্দ্র মোদি সরকারের সম্ভাব্য প্রত্যুত্তর নিয়ে যখন সকলে জল্পনা-কল্পনা করছেন, তখন এই প্রশ্নটাও গুরুত্ব পাচ্ছে যে – সৌদি আরব কেন পাকিস্তানকে অতটা কাছে টেনে নিচ্ছে?

২০১৩ সালে ‘পিউ রিসার্চ’এর এক গবেষণায় বলা হয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশে সৌদি আরবের গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকলেও পাকিস্তানে তা খুব ভালো অবস্থানে রয়েছে। পাকিস্তানের ৯৫ শতাংশ জনগণ সৌদি আরব সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে বলে সেই জরিপে বলা হয়, যেখানে ফিলিস্তিনের জন্যে সংখ্যাটা ছিল ৫২ শতাংশ, লেবাননে ৫১ শতাংশ, তিউনিসিয়ায় ৪০ শতাংশ এবং তুরস্কের জন্যে মাত্র ২৬ শতাংশ। মোটকথা, মধ্যপ্রাচ্যে সৌদিদের প্রতিবেশীদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কম হলেও দূরবর্তী মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলিতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা মোটামুটি ভালো। পার্শ্ববর্তী সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং কুয়েতের সরকারের সাথে সৌদি রাজপরিবারের সম্পর্ক ভালো থাকায় তারা সৌদিদের নিরাপত্তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ছোট জনসংখ্যার কারণে এই দেশগুলি নিজেদের নিরাপত্তা দিতেই হিমসিম খাচ্ছে।

সৌদি আরবের জনসংখ্যা ৩ কোটি ৪০ লাখের মতো। তবে দেশটার বিশালতার তুলনায় এই জনসংখ্যা কিছুই নয়। সৌদি সরকার তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আশেপাশের দেশগুলির মাঝে শুধু মিশরের উপরেই নির্ভর করতে পারবে। প্রায় ১০ কোটি জনসংখ্যার মিশরই একমাত্র সৌদি সরকারকে রক্ষায় বৃহৎ সেনাবাহিনী প্রেরণের সক্ষমতা রাখে।

২০১১ সালে ‘আরব বসন্ত’এর সময় সৌদিরা বাহরাইনের সরকারের নিরাপত্তা দিতে সেদেশে সৈন্য প্রেরণ করে। তুরস্কও কাতারের নিরাপত্তা দিতে সেখানে সামরিক ঘাঁটি করেছে।

১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেনের অধীনে ইরাক কুয়েত দখল করে ফেলার পর থেকে সৌদিদের নিরাপত্তা চিন্তা গভীর হতে শুরু করে। সৌদিদের হাত ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক শক্তি কমাতে থাকায় সৌদি আরবকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। আঞ্চলিক শক্তিদের সাথে প্রতিযোগিতায় সৌদিরা ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, লেবাননের রাজনীতিতে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত হয়েছে। পশ্চিমা দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় বাড়ানোর সাথে সাথে নিজস্ব অস্ত্র নির্মাণ শিল্পের দিকেও নজর দিয়েছে সৌদিরা, যা কিনা যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের পরিকল্পনারই অংশ।

পাকিস্তানের প্রায় ২০ কোটি জনসংখ্যার মাঝে সৌদিরা নিজেদের নিরাপত্তা দেখতে পায়। ইন্দোনেশিয়া সবচাইতে বড় মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ, যার জনসংখ্যা ২৬ কোটির উপর; বাংলাদেশের জনসংখ্যাও ১৭ কোটির মতো। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তান সৌদি আরব থেকে অপেক্ষাকৃত কাছে এবং পাকিস্তানের বর্তমান সেনাবাহিনী পৃথিবীর সবচাইতে বড় সেনাবাহিনীগুলির একটি।

২০১৩ সালের নভেম্বরে ‘বিবিসি’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সৌদিরা পাকিস্তানের পরমাণু প্রকল্পে সহায়তা দিয়েছে। একইসাথে সেই প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, সৌদিরা ইচ্ছে করলেই পাকিস্তানের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নিজের দেশে মোতায়েন করতে সক্ষম হবে। ২০০৯ সালে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ মার্কিন প্রতিনিধি ডেনিস রস-কে মনে করিয়ে দেন যে, যদি ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের সক্ষমতা অর্জন করে, তবে সৌদি আরবও পারমাণবিক অস্ত্র জোগাড় করে নেবে। অনেকেই মনে করেন যে, ইরানের পারমাণবিক আকাঙ্খাই সৌদিদেরকে পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্পে আগ্রহী করেছে।

তেলের বাজারে দরপতনের পর থেকে সৌদি আরবের অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে। প্রথমবারের মতো দেশের মানুষের উপরে করের বোঝা চাপানো হয়েছে কিছুদিন আগেই। ‘আরব বসন্ত’এর সময় সৌদি সরকার অর্থ বিতরণের মাধ্যমে তার জনগণকে যতো সহজে ঠাণ্ডা করতে পেরেছিল, সেটা তেলের মন্দা বাজারে আর সম্ভব নয়; যেকারণে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আগের অবস্থানে নেই। এই কারণেও সৌদিরা তাদের নিরাপত্তার জন্যে অন্য মুসলিম দেশগুলির উপর নির্ভর করবে।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনী ভারতের সাথে একাধিক যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে, যার ব্যাপারে সৌদি নেতৃত্ব অবগত রয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্বের কারণেই সৌদি আরবের সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের একটা বড় অংশ পাকিস্তানকে দিয়েছে সৌদি সরকার। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে সৌদিরা কতটুকু সন্মান দেয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সৌদি নেতৃত্বের ‘ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেরোরিজম কোয়ালিশন’ (আইএমসিটিসি)-এর কমান্ড থেকে। সৌদি নেতৃত্বে গঠিত হলেও আইএমসিটিসি-এর কমান্ডার পাকিস্তানের প্রাক্তন সেনাপ্রধান রাহিল শরীফ।

অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনীতি সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক ঋণের মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে। ‘সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ’এর এক বিশ্লেষণে বলা হয় যে, পাকিস্তান বর্তমানে গত দশ বছরের মাঝে তৃতীয়বারের মতো চলতি হিসেব নিয়ে বিপদে পড়েছে।

সৌদিরা সেই পাকিস্তানেই বিনিয়োগ করেছে, যারা কিনা সৌদিদের বিপদের সময়ে সামরিক সহায়তা দিতে পারে; এমনকি পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রও সৌদিদের পক্ষে মোতায়েন হওয়াটা অনেকে অবাস্তব মনে করেন না। সৌদিদের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাপে এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি কমানোর সাথে সাথে পাকিস্তানের মাঝে সৌদিরা নিজেদের নিরাপত্তার একটা স্তম্ভ দেখতে পাচ্ছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে