ভাষা দিবস। নিঃসন্দেহে বাঙালি জাতির জন্য একটি গর্বের দিন। নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকারের দাবীতে যে অল্পসংখ্যক জাতি আন্দোলনে নেমে রাস্তায় রক্ত দিয়েছে, বাঙালি-বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। কী ঘটেছিল ১৯৪৮ সালে এবং পরিণতি কী হয়েছিল ১৯৫২ সালে সেই হৃদয় বিদারক ঘটনা অল্প-বিস্তর আমাদের সবারই জানা আছে। সে বর্ণনায় না গিয়ে ভাষার তাৎপর্য এবং দরদের বর্তমার রূপটি একটু খতিয়ে দেখা যাক।
একজন মানুষ মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা কথা বলা শেখে, যে ভাষায় চিন্তা করতে শেখে, সেই ভাষা হল মাতৃভাষা। মায়ের কাছ থেকে শেখা ভাষায় নিজেকে যেভাবে ব্যক্ত করা যায়, পৃথিবীর তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য ভাষা শিক্ষাগ্রহণ করে সেভাবে ব্যক্ত করা যায় না। ফারসী কবি জালালুদ্দিন রুমী তার মসনভীতে লিখেছেন, হিন্দুয়ারা এসতেলাহে হিন্দ মদেহ/ সিন্ধীয়ারা এসতেলাহে সিন্ধ মদেহ। অর্থাৎ হিন্দুস্তানীদের জন্য হিন্দু ভাষাই উত্তম সিন্ধীদের জন্য সিন্দু ভাষাই উত্তম। এ কারণেই মাতৃভাষা জগতের প্রতিটি মানুষের কাছে মায়ের মত প্রিয়। প্রত্যেক ভাষাভাষিই তার মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিতে চায়। এবং দেওয়া উচিত।
কিন্তু তাই বলে ভাষা নিয়ে আদিখ্যেতার কোনো সুযোগ আছে বলে আমরা মনে করি না। একজন মা তার সন্তানকে ভালোবাসেন বলে নিশ্চয়ই অন্য মায়ের শিশুকে অবহেলা করেন না! নিজ ভাষাকে ভালোবাসা মানে অন্যভাষার প্রতি অবহেলা নয়। বরং অন্যভাষাকে রপ্ত করতে পারলে, অন্যভাষাকে নিজের ভাষার পাশাপাশি মর্যাদার আসন দিলে তাতে নিজ ভাষাই আরো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। ইংরেজরা উপনবেশ আমলে যেখানেই গিয়েছে, সেখানেই নিজ ভাষাকে চালু করার পাশাপাশি সেখানকার স্থানীয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে সহজেই মানিয়ে যাওয়ার মত শব্দ-বাক্য গ্রহণ করেছে। যার ফলে দিনে দিনে ইংরেজি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিকভাবে সবচে’ গ্রহণযোগ্য ভাষা। যেমন ভারত উপমহাদেশ থেকে সহজেই গ্রহণ করেছে গুরু, রুট, অবতার, ঝঙ্গল, চাটনি, ব্যঙ্গল, চিতা, ড্যাকয়েট, গরম মসল্লা, জিমখানা, খাকি, কর্মা, মন্ত্র, নির্ভানা, ভেরান্দাসহ অসংখ্য শব্দ। এমনকি কমলার ইংরেজি শব্দ অরেঞ্জ তামিল শব্দ নারাম এবং সংস্কৃতি নারাঙ্গা থেকে আরবদের কাছে যায় নারাঞ্জ হয়ে এবং ইংরেজের কণ্ঠে সেটা হয়ে যায় অরেঞ্জ। খাদ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কমলার আদিভূমি শ্রীলঙ্কা! আবার আফ্রিকার উপনিবেশ থেকে ইংরেজরা গ্রহণ করেছে ব্যনানা(কলা-পশ্চিম আফ্রিকা), শিম্পাঞ্জি( বানতু ভাষা), অ্যাপারথিড(দক্ষিন আফ্রিকা), ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি( সোহালি) এবং আরো অসংখ্য শব্দ। আরবি আল-কুট শব্দ থেকে এসেছে অ্যালকাহল। আবার তেতুল ভারতীয় ফল। আরবরা একে বলতো তামরহিন্দি, সেটাই মধ্যযুগীয় ল্যাটিন ভাষায় হয়ে যায় তামারইন্দুস এবং অবশেষে ইংরেজের কাছে তামারিন্ড।
শুধু গ্রহণই করেনি, অনেক শব্দ ইংরেজি ব্যবহার থেকে বিশ্বব্যাপি প্রচলিত হয়ে গিয়েছে। যেমন শুনতে অবাক লাগলেও শ্যাম্পু শব্দটি হিন্দুস্তানী বা ভারতীয় শব্দ। এর অর্থ ঘষা। সংস্কৃতি এবং সিংহলি ভাষা আমবারেলা থেকে এসেছে আমব্রেলা শব্দ। তখন শুধু নয়, ইংরেজরা এখনো গ্রহণ করছে। যার ফলে তাদের ভাষার একটি বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে সুবিধা হয়েছে।
বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার পাশাপাশি এসব কথা আমাদের মাথায় থাকা দরকার। নিজ ভাষার প্রতি দুর্বলতা যেন আমাদের অন্য ভাষাকে অবহেলা করতে না শেখায়। বাংলা এত শক্তিশালী ভাষা যে তা বিলুপ্ত হওয়ার ভয় নেই। অযথা ভাষার ব্যাপারে রক্ষণশীল হয়ে অন্য ভাষাভাষিদের কাছ তেকে দূরে সরে যাওয়ার সুযোগ বর্তমান দুনিয়ায় নেই। বৃটিশ শাসনামলে এদেশের দাপ্তরিক কাজ-কর্ম ইংরেজিতে হতো। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের সময়েও ইংরেজি চালু ছিল। তার আগে মুঘল স¤্রাটরা ফারসি ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলেন, যদিও তাদের মূল ভাষা ছিল চাগতাই তুর্কি। স¤্রাট বাবর তার বিখ্যাত আত্মজীবনী বাবরনামা লিখেছিলেন চাগতাই তুর্কি ভাষায়। কিন্তু তারই কন্যা গুলবদন বেগম মাত্র ৩০ বছর পর হুমায়ুননামা লিখেছিলেন ফারসি ভাষায়।
ফারসি এদেশে মুঘলস¤্রাটরা আমদানী করেননি। করেছিলেন মুঘলদের আগের সুলতানরা। বুরহানপুর, বিজাপুর, তেলেঙ্গানা, বাংলা এসব জায়গায় সুলতানরা ফারসি চালু করলেও পাশাপাশি স্থানীয় ভাষা সমানভাবে ব্যবহার করেছেন। তাতে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়নি।
সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা কিছু আন্তর্জাতিক যোগাযোগে বিঘœ ঘটাচ্ছি। যেমন এখন দেশে দিনে দিনে বিদেশিদের যাতায়াত বাড়ছে। আমরা পর্যটনকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করছি। কিন্তু ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা একটি সমস্যা যেটা আমরা লক্ষ্য করছি না। দেশে লাখ লাখ গাড়ি চলছে। এসব গাড়ির নাম্বার প্লেট এখন আর কোনোক্রমেই শুধু বাংলায় থাকা উচিত না। পাশাপাশি ইংরেজি ব্যবহার করা যেতে পারে। দেশের একজন স্বল্পশিক্ষিত মানুষও ইংরেজি অক্ষর ও সংখ্যার সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু কোনো বিদেশি বাংলার সঙ্গে পরিচিত নয়। রাস্তার সাইনগুলো সব কেবল বাংলা না থেকে ইংরেজি ব্যবহার করা উচিত।
বাংলাদেশি এক কোটির বেশি মানুষ প্রবাসে বসবাস করছেন। সরকার দেশ থেকে যে লাখ লাখ শ্রমিক প্রেরণ করছে মধ্যপ্রাচ্যে তারা অদক্ষ শ্রমিক। এই শ্রমিকরা যদি আরবি ভাষাটা রপ্ত করে যেতেন, তাহলেও তাদের সুযোগ-সুবিধা যেমন বৃদ্ধি পেত, সেই সঙ্গে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়তো। অধিকন্তু মধ্যপ্রাচ্যের লোকেরা স্বীকার করতে বাধ্য হতো যে বাঙালি মেধাবী জাত! বাংলাদেশে আরবি পড়া হয়। প্রায় সব মুসলমানই আরবি একটু আধুট উচ্চারণ করতে জানে। কিন্তু তা ধর্মী কারণে এবং এর সঙ্গে ভাষা শেখার কোনো সম্পর্ক নাই। বেশির ভাগ লোক অর্থ বোঝেন না, অথবা আরবিতে যোগাযোগ করতে পারেন না।
ঘরের কোণে চিন এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অথনীতির দেশ। প্রায় ১৫০ কোটি মানুষের এই দেশে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ ইংরেজি বা অন্য ভাষা জানে। কিন্তু চিন বেরিয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে, বিনীয়োগ ও অংশীদারিত্বের ব্যাবসা করতে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে চিনা ভাষা জানা মানুষ পেলেই লুফে নিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে হাজার হাজার ছেলে বেকার থাকা সত্বেও চিনের ভাষা শেখার কোনো আগ্রহ বোধ করছে না। পাকিস্তানে এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিনা ভাষা শেখানো হচ্ছে। কয়েক লাখ তরুণকে চিনা ভাষা শেখানো হচ্ছে। তাদের একেকটি ব্যাজ ভাষা শিখে বের হচ্ছে এবং সঙ্গে সঙ্গে হয় পাকিস্তানে অথবা চিনে চাকরি হয়ে যাচ্ছে। এরকম বাংলাদেশি তরুণরা চিনের ভাষা শিখলে নিঃসন্দেহে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দেবে।
ইউরোপের দেশগুলোতে দেখা যায়, স্কুল-কলেজে একাধিক ভাষা শেখানো হয়ে থাকে। তাতে তাদের ভাষা বিলুপ্তও হয়ে যায়না, অপমানিতও হয় না। ইউরোপিয় নাগরিকরা নিজেরা আরো সমৃদ্ধ হয় এবং পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা বাড়ে।
তবে সেই সঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। ভাষাকে যদি আমরা সত্যিই ভালোবাসি, তাহলে ভাষাটাকে রপ্তকরাও আমাদের দায়। দুঃখের বিষয় আজ খুব কম মানুষ চোখে পড়ে যারা বাংলা শুদ্ধ করে লিখতে পারেন। অফিস-আদালতে কর্মকর্তারা যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন তা দেখলে রীতিমতো লজ্জা করে। অতএব ভাষাকে সমৃদ্ধ করলেই ভাষা আরো সম্মানীত হবে, শুদু আণুষ্ঠানিকতা দিয়ে বাংলার মর্যাদাকে আমরা যেন মুড়িয়ে না ফেলি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক