যে রান্না ঘরে আপনি সারা বছর আগুন নিয়েই কাজ করছেন হাজার সাবধান থাকার পরেও সেখানে ঘটতে পারে নানা ধরনের দূর্ঘটনা। এছাড়া সচরাচর মানুষ যেসব দুর্ঘটনার শিকার হয়, তার মধ্যে অন্যতম পুড়ে যাওয়া। বিভিন্ন ধরনের দাহ্য পদার্থ যেমন-কেরোসিন, পেট্রল, এসিড, ক্ষার, বোমা বিস্ফোরণ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, গরম পানি, গ্যাস ইত্যাদি শরীর পুড়ে যাওয়ার কয়েকটি বড় কারণ। শরীরের কোনো অংশ পুড়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারলে পরবর্তী সময়ে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।
আমাদের সবারই সব ধরনের বিপদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিৎ। তাই হঠাৎ পুড়ে গেলে কি করবেন সেই সম্পর্কে কিছু ধারণা নিয়ে রাখলে আপনি হয়ত অনেক রকম বিপদ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
প্রাথমিকভাবে পুড়ে যাওয়া তিন ধরনের। পুড়ে যাওয়ার মাত্রা অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে। ফার্স্ট ডিগ্রি বা প্রথম বা স্বল্প মাত্রার পোড়া, সেকেন্ড ডিগ্রি বা দ্বিতীয় বা মধ্যম মাত্রার পোড়া, থার্ড ডিগ্রি বা তৃতীয় বা মারাত্মক মাত্রার পোড়া। চিকিৎসাও নির্ভর করে কোন মাত্রায় পুড়েছে তার ওপর।
প্রথম মাত্রার পোড়া: শুধু চামড়ার উপরিভাগ পুড়ে গেলে তাকে প্রাথমিক মাত্রার পোড়া বলা হয়, সাধারণভাবে যাকে সামান্য পোড়া বলে। চামড়া বা ত্বকে দুটি স্তর থাকে। এপিডার্মিস ও ডার্মিস। এ ক্ষেত্রে শুধু এপিডার্মিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর লক্ষণ হিসেবে-
. চামড়া লাল হয়ে যায়,
. আক্রান্ত স্থান ফুলে যায়,
. আক্রান্ত স্থানে ব্যথা থাকে।
তবে মুখ, যৌনাঙ্গ, নিতম্ব, অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে সামান্য পুড়ে গেলেও তাকে প্রথম মাত্রার পোড়া হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এ ক্ষেত্রে বিশেষায়িত চিকিৎসা নিতে হবে। এছাড়া প্রথম মাত্রার অন্যান্য পোড়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা নিলেও চলবে।
দ্বিতীয় মাত্রার পোড়া: চামড়ার এপিডার্মিস ও ডার্মিস উভয় স্তর পুড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে চামড়ায় বা ত্বকে-
. ফোসকা পড়ে,
. লাল হয়ে যায়,
. অতিরিক্ত ব্যথা অনুভূত হয়,
. ফুলে যায়।
দ্বিতীয় মাত্রার পোড়া সাধারণভাবে যদি তিন ইঞ্চি পরিমাণের বেশি বিস্তৃত না হয়, তবে সামান্য পোড়া হিসেবে প্রাথমিক চিকিৎসা নিলেও হবে। পোড়া অংশ যদি অধিক বিস্তৃত এবং হাত-পা, যৌনাঙ্গ, নিতম্ব, গিরায় বিস্তৃত হয়, তবে তা গুরুতর পোড়া হিসেবে অতিদ্রুত বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা করতে হবে।
তৃতীয় মাত্রার পোড়া: গুরুতর পোড়া। এ ক্ষেত্রে চামড়ার উভয় স্তর, চর্বি, মাংস এমনকি হাড়ও পুড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে-
. পোড়া অংশ কালো হয়ে যায় অথবা শুষ্ক ও সাদা বর্ণ ধারণ করে
. শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হয়
. কার্বন মনোক্সাইড নামক বাতাসের বিষাক্ত পদার্থ ফুসফুসে ঢুকে পড়ে
গুরুতর পোড়া রোগীর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দেরি না করে হাসপাতালে নিতে হবে। সম্ভব হলে সরাসরি বার্ন ইউনিটে রোগী স্থানান্তর করতে হবে।
তবে পোড়ার ক্ষেত্রে কত ডিগ্রি পুড়ে গেল তার ওপর রোগীর অবস্থা নির্ভর নাও করতে পারে। জরুরি বিষয় হলো-
. রোগী কতক্ষণ ধরে পুড়েছে,
. বাহ্যিকভাবে শরীরে পোড়ার বিস্তৃতি (ডাক্তাররা যা ‘রুল অব নাইন’ দিয়ে নিরূপণ করেন) কতখানি,
. মাথা, গলা, ঘাড়, বুক, পেট, যৌনাঙ্গ পুড়েছে কি না এই বিষয়গুলো চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণ পুড়ে যাওয়ার প্রাথমিক চিকিৎসা :
প্রাথমিক ও দ্বিতীয় মাত্রার পোড়া, সাধারণভাবে যার বিস্তৃতি তিন ইঞ্চির কম, সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক চিকিৎসা সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে। সরাসরি আগুনে পুড়ুক বা পেট্রল-এসিডের মতো রাসায়নিকে পুড়ুক প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে-
. সম্ভব হলে আক্রান্ত স্থান শীতল পানির প্রবহমান ধারার (যেমন ট্যাপের পানি) নিচে ১০-১৫ মিনিট ধরে রাখতে হবে। গা পুড়ে গেলে শাওয়ার বা গোসলের ঝরনার পানির নিচে দাঁড়াতে হবে।
. যদি সম্ভব না হয়, তবে আক্রান্ত স্থান বালতির পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পুকুর, নদীর পানিতেও ডোবানো যাবে।
. সেটাও সম্ভব না হলে, আক্রান্ত স্থানে পর্যাপ্ত পানি (গরম বা ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি নয়, সাধারণ তাপমাত্রার) ঢালতে হবে।
. পোড়া অংশ জীবাণুমুক্ত গজ বা ব্যান্ডেজ (তুলা নয়) দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যাতে জীবাণুর সংক্রমণ না হয়।
. ব্যথানাশক সেবন করতে হবে। সাধারণ পোড়ায় প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রফেন-জাতীয় ব্যথানাশক সেবন করা যেতে পারে।
. পোড়ার মাত্রা রোগীর পক্ষে সব সময় বোঝা সম্ভব নয়। তাই অল্প পুড়লেও একবার ডাক্তার দেখানো উচিত।
সতর্কতা:
. পোড়া অংশ বরফের পানি, ফ্রিজের পানি বা বরফ দেওয়া যাবে না। গরম পানিও ঢালা যাবে না।
. ডিম, টুথপেস্ট, মাখন এবং ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের মলম ব্যবহার করা যাবে না।
. তুলা দিয়ে ড্রেসিং করা বা পোড়া অংশ ঢেকে রাখা যাবে না। শুকনো গজ বা ব্যান্ডেজ ব্যবহার করতে হবে।
. ডাক্তার দেখানোর আগে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করবেন না।
গুরুতর পুড়ে যাওয়ার চিকিৎসা :
প্রাথমিক মাত্রার পোড়ার ক্ষেত্রে যে ধরনের সাধারণ চিকিৎসা দেওয়া যায়, এখানেও তা করা যাবে। তবে গুরুতর পোড়ার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নেওয়াটা বেশি জরুরি। তাই প্রাথমিক চিকিৎসায় যেন অতিরিক্ত সময় ব্যয় না হয়।
গুরুতর পুড়ে যাওয়া রোগীর শরীর থেকে যতটা সম্ভব পরিধেয় কাপড় খুলতে হবে। তবে এটা যেন টানা-হ্যাঁচড়া করে না করা হয়। এতে আক্রান্ত স্থান আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
আবার এ ধরনের রোগীকে ঠাণ্ডা পানিতে ডুবানো উচিত নয়। কারণ শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ কমে গিয়ে বিপদ হতে পারে।
পোড়া রোগীর অনেকের মৃত্যু ঘটে ধোঁয়ার কারণে। ধোঁয়ার মাধ্যমে শ্বাসনালিতে কার্বন মনোক্সাইড প্রবেশ করে। তাই আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ওই স্থান থেকে রোগীকে দূরে নিতে হবে। রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস সঠিক রাখার জন্য শার্টের কলার, টাই, বুকের কাপড় শিথিল করে দিতে হবে।
পোড়া রোগীর বিপদ চিহ্ন :
. রোগী অজ্ঞান হওয়া/অতিরিক্ত পানিশূন্য হয়ে শকে চলে যাওয়া,
. বাতাসের বিষাক্ত ধোঁয়া ফুসফুসে গিয়ে শ্বাসতন্ত্র সংক্রমিত হওয়া, শ্বাসনালি ফুলে যাওয়া ও শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া,
. পোড়া অংশে জীবাণুর সংক্রমণের মাধ্যমে ইনফেকশনে বিস্তৃতিলাভ করা,
. শরীরে পানি ও লবণের অসাম্যতা (ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স) দেখা দেওয়া,
. প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া,
. শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়া,
. খিঁচুনি হওয়া,
. জমাট বাঁধা রক্ত দিয়ে রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
মনে রাখা জরুরি:
. শরীরে আগুন লেগে গেলে ওই স্থান থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরে যান, বিশেষ করে গাড়ির ভেতর থেকে দ্রুত বের হতে হবে। আগুনের ধোঁয়া থেকে দূরে যান।
. দৌড়াবেন না। এতে আগুন আরো বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
. শুয়ে পড়ে বারবার মাটিতে গড়াগড়ি দিন। এতে জামা-কাপড়ের আগুন নিভে যাবে এবং আগুনের বিস্তৃতি লাভের ঝুঁকি কমবে। এ সময় দুই হাত দিয়ে মুখ, গলা ঢেকে রাখা উচিত।
. মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, ভয় পাওয়া যাবে না। ভীত হলে মানুষ স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না।
. হঠাৎ সিদ্ধান্তে উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে না পরে পরিস্থিতি বিবেচনা করুন। আতঙ্কে উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়ে হাত পা ভাঙার মতো বিপদ যেমন ঘটে, তেমনি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
. বাড়িতে আগুন লাগার উপকরণ গ্যাসের চুলা, ম্যাচ বক্স, ইলেকট্রিক সুইচ সাবধানে ব্যবহার করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে ও বাড়িতে আগুন নেভানোর উপকরণ রাখা উচিত।
. আগুন লাগলে কী করা উচিত সে বিষয়ে বাড়ির শিশু-বৃদ্ধ সবাইকে প্রাথমিক ধারণা দিন।
. চারদিকে আগুন থাকলে মাথা নিচু করে নাক চেপে দ্রুত স্থান ত্যাগ করুন।
. আগুনের ওপর ভেজা কম্বল বা কাপড় বা বালু চাপা দিন।
পরবর্তী চিকিৎসা :
পোড়ার চিকিৎসা বিশেষায়িত হাসপাতালে করা উচিত। সেখানে ক্ষতস্থান সেরে ওঠার চিকিৎসা করা হয়। পরবর্তী সময়ে সৌন্দর্য ও কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য আরো কিছু চিকিৎসারও প্রয়োজন হতে পারে। এ ধরনের চিকিৎসার মধ্যে আছে-স্কিন গ্রাফট, মাইক্রোসার্জারি ইত্যাদি।