গাড়ির বা রেস্তোরাঁর গ্যাস সিলিন্ডার নয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকেই চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটেছিল বলে একটি তদন্তে উঠে এসেছে। আর এতে নিহত হয়েছে ৭১ জন।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) তদন্ত প্রতিবেদনে এই আগুন ভয়াবহ হয়ে ওঠার জন্য ওই ভবনটির দ্বিতীয় তলায় থাকা দাহ্য প্রসাধনী ও অন্যান্য সামগ্রীর বিপুল মজুদকে দায়ী করা হয়েছে।
কী থেকে আগুন কীভাবে লেগেছিল, তা নিশ্চিত করতে না পারলেও প্রকৌশলীদের সংগঠনটির তদন্তকর্তারা বলছেন, বৈদ্যুতিক সুইচ অন করার সময় স্ফূলিঙ্গ থেকে বা অসাবধানতাবশত জ্বালানো আগুন থেকে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে যে পাঁচটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা ওয়াহেদ ম্যানশনের। সড়কে থাকা অনেকগুলো যানবাহনও পুড়ে যায়।
এই আগুনের ভয়াবহতা সবাইকে ৯ বছর আগের নিমতলীর কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল, যেখানে রাসায়নিকের গুদামে আগুনে নিহত হয়েছিলেন শতাধিক।
১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় চুড়িহাট্টার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুন আগুনের সূত্রপাতের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণকে দায়ী করেছিলেন; ওই এলাকার ব্যবসায়ীরাও একই রব তুলেছিল। বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণের কথাও বলছিলেন কেউ কেউ।
কিন্তু ক’দিন বাদে বিভিন্ন সংস্থার তদন্তকারীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে গ্যাস সিলিন্ডার কিংবা ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণের কোনো আলামত না পাওয়ার কথা জানিয়ে ওয়াহেদ ম্যানশনের দাহ্য পদার্ধের গুদামের দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন।
আইইবির তদন্ত দল এবার সরাসরি ওয়াহেদ ম্যানশনের দাহ্য পদার্থের গুদামকেই অগ্নিকাণ্ডের উৎসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করল।
আইইবির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মনজুর মোর্শেদ মঙ্গলবার গণমাধ্যমকে বলেন, এই আগুনের সুত্রপাত রাসায়নিক থেকেই।
তিনি বলেন, আমরা শতভাগ নিশ্চিত এটা কেমিকেল থেকে সৃষ্টি হয়েছে, অন্য কিছু না। অন্য কিছু হলে নিচে থেকে আগুন আসত। নিচে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ বা সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়নি। সবকিছুই ঠিক ছিল।
ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকেই আগুনের সুত্রপাতের বিষয়টি নিশ্চিত হলেন কীভাবে- এ প্রশ্নে আইইবির তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. নুরুল হুদা বলেন, তারা পরিদর্শনের সময় কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখেছিলেন, কিন্তু ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলা থেকেই বিস্ফোরণের পক্ষে প্রমাণ পেয়েছেন।
তিনি বলেন, তিনটা দিক থেকেই পরীক্ষা করেছি। বাইরে কোথাও একটা বিস্ফোরণ হলে এটা ওয়ালে ধাক্কা খেলে ওয়ালটা ভেতরের দিকে যাবে। কিন্তু এটা ভেতরের দিকে যায়নি। বাইরের দিকে গেছে। যখন একটা রুমের ভেতরে বিস্ফোরণ হয় তখন তখন ওয়াল ভাঙলে বাইরের দিকে যায়।
নুরুল হুদা বলেন, ওইখানে আমরা দেখেছি ওই রুমের থেকে জিনিসগুলো বাইরের দিকে গেছে। এটা দেখে আমাদের মনে হয়েছে এটা ভেতরের থেকে হয়েছে। বাইরে থেকে নয়।
অগ্নিকাণ্ডের দুদিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি এই তদন্ত কমিটি গঠন করে আইইবি। সংগঠনের সাবেক সভাপতি নুরুল হুদাকে আহ্বায়ক এবং সহকারী সাধারণ সম্পাদক (একাডেমিক ও আন্তর্জাতিক) কাজী খায়রুল বাশারকে সদস্য সচিব করে এই কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটিতে আইইবির কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য হামিদুল হক, অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নুর, আইইবির তড়িৎকৌশল বিভাগের সদস্য ড. ইয়াছির আরাফাত এবং কেমিকৌশল বিভাগের সদস্য ড. কাজী বায়েজিদ কবিরও ছিলেন।
কমিটির সদস্যরা গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে প্রতিবেদন তৈরি করে ২ মার্চ তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেন বলে আইইবির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মনজুর মোর্শেদ জানান।
তিনি বলেন, আমরা রিপোর্ট তৈরি করে তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিয়েছি। সেখানে আমরা বিভিন্ন সুপারিশমালা দিয়েছি। আমাদের কী পর্যবেক্ষণ ছিল, ঘটনাস্থলের বর্ণনা, অগ্নিকাণ্ডের কী কারণ, এসব কিছুই বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন বা আমলে নিলে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলে আমি মনে করি।
উল্লেখ্য, এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সরকারিভাবে পাঁচটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এই তদন্ত কমিটি গঠন করে।
তবে বেসরকারি উদ্যোগে আইইবির করা তদন্তের প্রতিবেদনই প্রথম প্রকাশ পেল।
যা আছে প্রতিবেদনে :
আইইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ ও মোবাইল ক্যামেরার কিছু ভিডিওতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেখে অনেকেই দাবি করেছে, আগুন ওয়াহেদ ম্যানশনের বাইরে থেকে শুরু হয়ে ভবনে ছড়িয়েছে। কিন্তু মসজিদের পাশের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে এয়ার ফ্রেশনারের ক্যান রাস্তার উপর এসে পড়তে দেখা গেছে। তাতে আপাত দৃষ্টিতে আগুন ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এছাড়া বিপুল পরিমাণে অতি দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন লাগার পর বিস্ফোরণের দেয়াল ভেঙে পড়েছে এবং অভ্যন্তরীণ দেয়ালের পলেস্তরা খসে পড়েছে। তবে ভেতরের দিকে অক্সিজেনের সরবরাহ কম থাকায় আগুন সেদিকে বাড়তে পারেনি। এজন্য ওয়াহেদ ম্যানশন সংলগ্ন ওয়াহেদ মঞ্জিলের কোনো ক্ষতি হয়নি। তার বদলে আগুন রাস্তার দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
যা মিলল পর্যবেক্ষণ :
তদন্ত কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের আশপাশের এলাকা পরিদর্শনের সময় দেখা গেছে, সেখানে ডিপিডিসির বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ছিল না। বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনেও শর্ট সার্কিটের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ট্রান্সফরমার যেখানে ছিল, সেখানে তা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনও অক্ষত ছিল।
সরেজমিন পরিদর্শনের বরাত দিয়ে কমিটি বলেছে, প্লাস্টিক দানা নেওয়ার জন্য যে পিকআপ ভ্যানটি ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল, তা ডিজেলচালিত। আরেকটি একটি পিকআপ/মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী ভস্মীভূত ও প্রায় অক্ষত অবশিষ্টাংশ দেখা যায়। এরমধ্যে যেসব সামগ্রীর লেবেল অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে, বাদামের তেল, রেড়ীর তেল, অলিভওয়েল, এয়ার ফ্রেশনার ও সুগন্ধী। এছাড়া আরও কিছু প্রসাধনীও অক্ষত ছিল।
ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় প্রসাধনী সামগ্রী মজুদ ছাড়াও খালি ক্যানে পারফিউম, এয়ার ফ্রেশনার রিফিল করা হতো। এগুলো উদ্বায়ী ও দাহ্য পদার্থ। পারফিউমের অন্যতম উপাদান ইথানলের ফ্ল্যাশ পয়েন্ট ১৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এয়ার ফ্রেশনারের ক্যানে প্রোপিল্যান্ট হিসেবে এলপিজি ব্যবহৃত হয়। বাতাসে এয়ার ফ্রেশনারের ঘনত্ব আনুমানিক শতকরা একভাগ হলেই তা দাহ্যতার নিম্নসীমা অতিক্রম করে এবং স্ফূলিঙ্গের উপস্থিতিতে আগুন ধরে বিস্ফোরণ হতে পারে। এলপিজি সাধারণত নিচু ও বন্ধ জায়গায় জমা হয়। জমাটবাধা এলপিজি অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এবং স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসামাত্র ফ্ল্যাশ ব্যাকের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
সুপারিশ :
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এগুলো হলো, আইন ও বিধির অসামঞ্জস্যতা অবসানে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি করা। সে কমিটির মাধ্যমে সংস্থাগুলোর সব আইন ও বিধির সমন্বয় করে নতুন একটি সমন্বিত আইন ও বিধি প্রণয়ন করা। যার যার কর্মপরিধি অনুযায়ী সমন্বিতভাবে কার্য সম্পাদন করা ও কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ করা। এই কাজগুলোর সমন্বয়ের জন্য সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কাছে দায়িত্ব দেওয়া। তা না হলে দুই সিটিসহ রাজউকের অন্তর্গত এক হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পরিচালনার জন্য একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা।
এতে আরও বলা হয়েছে, পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো অত্যন্ত সরু এবং সড়কগুলো যানবাহন চলাচলের অযোগ্য। এই এলাকার বাসিন্দাদের পর্যায়ক্রমে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে নতুনভাবে পরিকল্পিত নগরায়ণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
কেরানীগঞ্জ বা সাভারে কেমিকেল পল্লী গঠনের মাধ্যমে দাহ্য পদার্থের গুদাম সরানোর ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে আইইবি।
রাসায়নিক ব্যবসায়ী, গুদামজাত ও পরিবহনে নিয়োজিত সবাইকে এর ব্যবহার ও সংরক্ষণের ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিস্ফোরক দ্রব্যাদির আমদানি, মজুত, বিতরণ ও ব্যবহারের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করার উপর জোর দিয়েছে আইইবি।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনসিসি) এবং ইমারাত নির্মাণ বিধিমালার প্রয়োগ নিশ্চিত করার সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজউক ও সিটি করপোরেশন আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা।