পরিবর্তন আসছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায়

বিশেষ প্রতিনিধি

বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি

অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এ লক্ষ্যে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক একেএম আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।

খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করার ফলে নিয়মিত ঋণখেলাপি হওয়ার সময়সীমা বাড়বে। ব্যাংক ও ঋণ গ্রহীতা পাবেন বাড়তি সুবিধা । কমবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। তবে সংজ্ঞা পরিবর্তনে অর্থনীতিবিদরা বিরোধিতা করছেন। তাদের মতে, সংজ্ঞা পরিবর্তন হলে সাময়িকভাবে হয়তো খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো সম্ভব। কিন্তু এর ফলে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এ লক্ষ্যে গঠিত কমিটি খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার মধ্যে বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনার পর সুপারিশ করবে। এর মধ্যে আছে, ঋণ শ্রেণীকরণের নীতিমালা, খেলাপি ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের সংজ্ঞা পর্যালোচনা। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশে ঋণ শ্রেণীকরণের বিদ্যমান নীতিমালা কিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায় সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করবে। খেলাপি ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের সংজ্ঞা পর্যালোচনার করা হবে।

এতে কিভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালককে ঋণখেলাপির দুর্নাম থেকে ছাড় দেয়া যায় সে বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এছাড়া কমিটি ঋণবিষয়ক আরও কিছু বিষয়ে সুপারিশ করবে।

বর্তমান সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণ করেই ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের আগ্রহ প্রকাশ করে। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এবং নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতের বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে এসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

সূত্র জানায়, এই আইনে সংশোধনী এনে কিছুটা শিথিল করা হতে পারে। এর মধ্যে শেয়ারের পরিমাণ ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দেয়া হতে পারে। একই সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিস্ট কোম্পানির খেলাপির দায় ওই কোম্পানির মূল পরিচালকদের ওপর দেয়া হতে পারে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট পরিচালককে অব্যাহতি দেয়া হতে পারে।

এতে স্বার্থসংশ্লিস্ট কোম্পানির পরিচালক বা তাদের মূল কোম্পানি বাড়তি সুবিধা পাবে। খেলাপি ঋণের দুর্নাম যেমন বহন করতে হবে না, তেমনি ওই ব্যক্তি বা তার মূল কোম্পানির ঋণ পেতে কোনো সমস্যা হবে না।

প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী সাধারণ ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তিন মাস পর ঋণটি নিুমান হিসাবে শ্রেণীকৃত হয়। একইভাবে ছয় মাস পর সন্দেহজনক এবং নয় মাস পর মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হয়।

এছাড়া মেয়াদি ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় উত্তীর্ণ হওয়ার ছয় মাস পর নিুমান, এক বছর পর সন্দেহজনক এবং দেড় বছর পর মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণীবিন্যাসিত হয়। এটিই খেলাপি ঋণ শ্রেণীকরণের আন্তর্জাতিক মানের রীতি।

সরকার এই নীতিমালা আংশিক শিথিল করতে চাচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণ ঋণের শ্রেণীকরণের নিয়মটি তুলে দিয়ে মেয়াদি ঋণের শ্রেণীকরণটি সব খাতে চালু করতে চাচ্ছে। এটি হলে সাধারণ ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ ৩ থেকে ৯ মাস পর্যন্ত বাড়বে। মেয়াদি ঋণ শ্রেণীকরণের মেয়াদ অপরিবর্তিত রাখা হতে পারে।

এতে নিয়মিত সাধারণ ঋণখেলাপি হওয়ার সময়সীমা বেড়ে যাবে। ফলে ব্যাংক ও ঋণ গ্রহীতা বাড়তি সুবিধা পাবে। একই সঙ্গে কমবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

সূত্র জানায়, এর আগে রাজনৈতিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছিল। ওই সময়ে সাধারণ ঋণ নিুমান হওয়ার সংজ্ঞা তিন মাসের পরিবর্তে ছয় মাস করেছিল। অন্যান্য শ্রেণীকৃত ঋণের মেয়াদও বাড়ানো হয়েছিল। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে গিয়েছিল।

কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের হিসাব মেনে নিতে আপত্তি তোলে। তাদের অভিযোগ ছিল ঋণখেলাপি হওয়ার মেয়াদ বাড়িয়ে এর পরিমাণ কমানো হয়েছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাধ্য হয়ে ওই নীতিমালা পরিবর্তন করে বর্তমান নীতিমালা চালু করে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, কমিটি যেসব সুপারিশ করবে সেগুলো দেশি ও আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো সামনে নিয়েই পর্যালোচনা করা হবে। কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন কোনো সমস্যা তৈরি করা হবে না। বরং সৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী না হলে বিদেশে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে। আইন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ বিষয় বিবেচনা করা উচিত।

প্রচলিত নিয়মে কোনো ঋণ খেলাপি হলে এর গ্রাহক পরিশোধ না করলে এর দায় গ্যারান্টার বা জামিনদারের ওপর বর্তায়। তখন গ্যারান্টারও খেলাপি হয়ে যায়। গ্রাহক পরিশোধ না করলে এক দফা জামিনদারকে নোটিশ দিয়েই তাকে খেলাপি করা যায় বর্তমান আইনে।

সূত্র জানায়, জামিনদারদের খেলাপির দায় থেকে কিছুটা ছাড় দিতে নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। একবারের পরিবর্তে তিন দফা নোটিশ দিতে হবে। একই সঙ্গে গ্যারান্টির ধরন অনুযায়ী খেলাপির দায় কতটুকু বর্তাবে তা নির্ভর করবে।

একেএম আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির দেয়া সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালকে প্রধান করে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের ১০ সদস্যের কমিটি।

এ কমিটির সদস্য হিসাবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম, আবু ফারাহ মো. নাছের, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ২ জন প্রতিনিধি, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক একেএম আমজাদ হোসেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মহাব্যবস্থাপক সহিদুল ইসলাম, ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের যুগ্ম পরিচালক রাশিদা খানম ও রিজিয়া ফারহানা খান রয়েছেন।

কমিটির সদস্য সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক শাহরিয়ার সিদ্দিকী। এই কমিটি গভর্নরের কাছে সুপারিশ করবে। পরে এ বিষয়ে সার্কুলার জারি করা হবে।

সূত্র জানায়, ব্যাংক কোম্পানি আইনে দেয়া ক্ষমতা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা সময় সময় পরিবর্তন করে সার্কুলার জারি করতে পারে। একই সঙ্গে কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর ব্যাখ্যাও দিতে পারে। ফলে প্রচলিত আইনে যে সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেয়া আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতে পরিবর্তনও আনতে পারে।

এছাড়া ব্যাংকিং খাতের সমস্যাগুলো সমাধান করতে কোম্পানি আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইন, অর্থঋণ আদালত আইন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, নেগোসিয়েবল ইন্সট্র–মেন্ট অ্যাক্ট ও দেউলিয়া বিষয়ক আইন পর্যালোচনা করা হবে।

এতে অনেক বিধি সংযোজন বা বিয়োজন করা হবে। একই সঙ্গে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রচলিত আইনের ধারাগুলো আরও কঠোর করা হবে। এগুলো যাতে সহজে প্রয়োগ করা যায় সে ব্যবস্থাও নেয়া হবে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে