দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের জন্য সুখবর আসছে। খুলছে তাদের চাকরির দ্বার। চলতি বছর সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের বিপরীতে প্রায় তিন লাখ লোক নিয়োগ দেবে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি পদে প্রায় ৫০ হাজার অস্থায়ী ভিত্তিতে (অ্যাডহক) এবং বিভিন্ন পদে স্থায়ীভাবে প্রায় দুই লাখ লোক। সরকারি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে প্রায় পাঁচ হাজার লোক নিয়োগের চিন্তাভাবনাও রয়েছে। এ জন্য শিগগিরই ৪১তম বিসিএসের সার্কুলার জারি করা হবে। ৪০তম বিসিএসের সার্কুলার জারি করা হয়েছে ইতিমধ্যে। মোট এক হাজার ৯০৩ জন ক্যাডার নিয়োগ দেওয়া হবে এ বিসিএসে। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীতে ৬০ হাজার, শিক্ষা খাতে ৪০ হাজার, স্বাস্থ্য খাতে ৩৫ হাজার, ব্যাংকিং খাতে ২০ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় এই নিয়োগ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। সরকারি একাধিক সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
সূত্র জানায়, এই লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে আগামী জুন থেকে। ইতিমধ্যে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শূন্য পদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ১০ শতাংশ শূন্য পদ রেখে বাকি পদে শিগগিরই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করবে তারা। পাশাপাশি অ্যাডহক ভিত্তিতে যেসব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে, তারও একটি তালিকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে সরকারি সংস্থাগুলোর শূন্য পদে লোক নিয়োগ চলমান প্রক্রিয়া। পদ শূন্যের ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনবল নিয়োগ দেয়। কিন্তু বর্তমানে কিছু কিছু খাতে শূন্য পদের সংখ্যা বেশি। এটি পূরণে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে শূন্য পদে লোক নিয়োগে বিভিন্ন সময়ে জারি করা পরিপত্রের নির্দেশনা কার্যকর করতে সচিবদের বলা হয়েছে। প্রথম শ্রেণি পদ বাদে অন্য যেসব পদে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে, সেসব পদে এভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে।’
গত বছর সচিব সভায় প্রশাসনের শূন্য পদ দ্রুত পূরণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জাতীয় নির্বাচনের আগে সচিব সভায় শূন্য পদ পূরণে প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক সচিবকে তাগিদ দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এ ছাড়া গত ২৫ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এক কোটি ২৮ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থায় শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগে শূন্য পদের তথ্য এবং পদ পূরণের জন্য কর্মপরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠি গত ৪ মার্চ সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থায় পাঠানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে শূন্য পদে লোক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে যেসব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে তারও একটি তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয় ওই বৈঠকে। নিয়োগের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতেও জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া বৈঠকে বলা হয়, যেসব পদে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া যাবে তার একটি তালিকা তৈরি করতে হবে স্ব স্ব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে। জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয় এটি যাচাই-বাছাই করে এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগের অনুমতি দেবে। এ বৈঠকের পরই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শূন্য পদে লোক নিয়োগের তালিকাসহ বিভিন্ন পদে সম্ভাব্য অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগের তালিকা তৈরির কাজ করছে।
জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে ২০ লাখ ৫০ হাজার ৮৬১টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে তিন লাখ ৯৯ হাজার ৮৯৭টি পদ। প্রথম শ্রেণির পদ শূন্য রয়েছে ৪৮ হাজার ৭৯৩টি। এর মধ্যে ১০ হাজার ৬৬৭টি রয়েছে সহকারী সচিব পদমর্যাদার। দ্বিতীয় শ্রেণির শূন্য পদ রয়েছে ৬৫ হাজার ৮৩টি। তৃতীয় শ্রেণিতে শূন্য পদ রয়েছে দুই লাখ ছয় হাজার ৭৬০টি। চতুর্থ শ্রেণিতে ৭৯ হাজার ২৬১টি। এবার আইন-শৃঙ্খলা খাতে সবচেয়ে বেশি লোক নিয়োগ হবে। এ খাতে নিয়োগ হবে প্রায় ৬০ হাজার লোক। স্বাস্থ্য খাতেও নিয়োগ হবে প্রায় ৩০ হাজার। এ ছাড়া শিক্ষা, ব্যাংক, কৃষি, রেলসহ অন্যান্য খাতে প্রায় দুই লাখ লোক নিয়োগ হবে। স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত করতে নিয়োগ দেওয়া হবে পাঁচ হাজার প্রকৌশলীকেও।
যেসব খাতের শূন্য পদে লোক নেওয়া হবে :দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিকদের সেবা সুবিধা বাড়াতে পুলিশে ৫০ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হবে। শিগগিরই এই লোক নিয়োগের সার্কুলার দেবে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ছাড়াও আনসার-ভিডিপি, বিজিবি ও দমকলসহ বিভিন্ন বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হবে পাঁচ হাজার লোক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসব বাহিনীর শূন্য পদের তালিকা দেওয়া হলে কাজ শুরু করবে সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলো।
শিক্ষা খাতে ৫০ হাজার : দেশের শিক্ষা খাতের বিভিন্ন পদে প্রায় ৫০ হাজার লোক নিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে ৫৯৭ সরকারি কলেজে প্রভাষকের প্রায় পাঁচ হাজার পদ শূন্য রয়েছে। ৪১তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকার কলেজগুলোরও শূন্য পদ পূরণ করা হবে। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে প্রায় ২৫ হাজার। ইতিমধ্যে ১০ হাজার শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান। বাকি ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগে শিগগিরই সার্কুলার দেওয়া হবে। এ ছাড়া পিয়ন ও দপ্তরি পদে প্রায় পাঁচ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়ার চিন্তাভাবনা রয়েছে। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন করে হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা নিয়োগের প্রতিশ্রুতি রয়েছে সরকারের।
স্বাস্থ্য খাতে ৩০ হাজার :দেশে বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে এক লাখ ৭৬ হাজার ৪৭৫টি পদের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার ৮৯টি পদ শূন্য রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানে সাত হাজার নার্স, সাড়ে ছয় হাজার স্বাস্থ্য সহকারী ও তিন হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এ খাতে প্রায় ১২ হাজার পদ শূন্য। তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সেবা পরিদপ্তর দ্রুততম সময়ে এসব শূন্য পদ পূরণ করবে। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে গত বছর বড় ধরনের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদ শূন্য রয়েছে তার পরও। আর এসব শূন্য পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু হবে। এর মধ্যে কিছু পদে নিয়োগে সার্কুলার দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক সেক্টরে ২০ হাজার :চলতি বছরের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার লোক নিয়োগ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। শিগগিরই বিভিন্ন পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। খুব শিগগিরই এটি সম্পন্ন হবে। এ ছাড়া ব্যাংকের বিভিন্ন পদে আরও পাঁচ হাজার লোক নেবে বলে জানা গেছে।
খাদ্য, কৃষি মন্ত্রণালয় ও রেলওয়েতে ৬০ হাজার : খাদ্য অধিদপ্তরে প্রায় পাঁচ হাজার লোকবল নিয়োগের প্রক্রিয়া ঝুলে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যেই শেষ হবে এ নিয়োগ। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তরগুলোর বিভিন্ন পদে আরও পাঁচ হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হবে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়াও পর্যাপ্ত লোকের অভাবে রেলওয়ে বিভাগ গত প্রায় এক যুগ ধরে রীতিমতো ধুঁকছে। শূন্য পদে লোক নিয়োগসহ রেলওয়েকে আধুনিক করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মামলার কারণে এ নিয়োগ ঝুলে গেছে। দ্রুত এ মামলা নিষ্পত্তি করে এ নিয়োগ সম্পন্ন হবে বলে সূত্র জানায়। এ ছাড়া রেলওয়ের বিভিন্ন পদে শিগগিরই আরও আট হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে বেশিরভাগই অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগের চিন্তাভাবনা চলছে।
অন্যান্য খাতে ৫০ হাজার :আগামী বছরের শুরু থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিভিন্ন পদ, সমাজসেবা অধিদপ্তরের সমাজসেবা অফিসার, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, কন্ট্রোলার জেনারেল ডিফেন্স ফাইন্যান্সের অডিটর, কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের অডিটর, পাট অধিদপ্তরের সহকারী পরিদর্শক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বিভিন্ন পদ, কারা তত্ত্বাবধায়ক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার, বাংলাদেশ বেতারের নিরাপত্তা অফিসার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার, গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের সহকারী তথ্য অফিসার ও উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদে ৫০ হাজার লোক নিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে অর্ধেক পদেই অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ হবে।