কিছু ভুল নীতির কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের বস্ত্র খাত। চীন, ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশে বস্ত্র খাত স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার সরকার এ শিল্পের উন্নতি আরও ত্বরান্বিত করতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রণোদনা প্রদানসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। অথচ বাংলাদেশের অবস্থা একেবারেই বিপরীত মেরুতে।
উদ্যোক্তাদের মতে, বলতে গেলে শুধু মাটি, পানি ও শ্রম ছাড়া বস্ত্র খাতের সবই আমদানিনির্ভর। কার্যত গার্মেন্টসের নামে আমরা ‘দর্জিগিরি’ ছাড়া আর কিছু করছি না। কারণ এ শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তথা কাঁচামাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনে সরকারি তরফে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ কিংবা প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যদিও গার্মেন্ট শিল্পে দেশ অনেক এগিয়েছে বলে দাবি করা হয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমদানির তথ্য গোপন করে কাগজ-কলমে বিশাল রফতানির তথ্য দেখিয়ে বাহবা নিচ্ছে। অনেকের ভাষায়, যা সত্যের অপলাপ মাত্র।
এদিকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানির নির্ভরতা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, সোয়েটারে ৯০ শতাংশ, ওভেনে ৮০ শতাংশ এবং নিট খাতে ৩০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঁচামালের এমন আমদানিনির্ভরতার বোঝা মাথায় নিয়ে বস্ত্র খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
একমাত্র সরকারই পারে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করে এর সমাধান দিতে। তারা মনে করেন, সরকারের এখনই উচিত হবে এ সেক্টরের জন্য স্থানীয়ভাবে সব শ্রেণীর কাঁচামাল উৎপাদনে শিল্প উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সাপোর্ট দেয়া, বন্ডের নামে কালোবাজারে আমদানিকৃত কাপড় ও সুতার কেনাবেচা একেবারে বন্ধ নিশ্চিত করা, একই সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতার পথ বন্ধ করতে সুতা এবং কাপড়ের আমদানি নির্ধারিত সময়ের জন্য বন্ধ রাখা অথবা বিশেষ প্রয়োজনে স্থানীয় বাজার থেকে সুতা ও কাপড় কিনতে সিলিং বেঁধে দেয়া।
এছাড়া সিঙ্গেল ডিজিটসহ সহজ শর্তে ঋণ নিশ্চিত করা। সর্বোপরি এ সেক্টরের উদ্যোক্তাদের নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক ডেকে একটি পলিসি নির্ধারণ করা।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ওভেন খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে না পারলে ব্যবসা অন্য দেশে চলে যাবে। কারণ বিদেশি ক্রেতারা এখন লিড টাইমকে গুরুত্ব দেন, কম সময়ে পণ্য ডেলিভারি চান। এখনও ৬০-৬৫ শতাংশ ফেব্রিক্স চীন-ভারত থেকে আমদানি করতে হয়।
তিনি বলেন, বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় ওভেন খাতে স্বল্প সুদে ঋণ দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন) থেকে কম সুদে ঋণ নিতে সরকার ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে পারে। পাশাপাশি ঘন ঘন পরিবর্তন না করে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন ও এই খাতে প্রণোদনা চালু করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সরকার নিট খাতে প্রণোদনা দেয়ায় এখন এই খাত কিছুটা এগিয়েছে। এজন্য ওভেনে প্রণোদনা দেয়া খুবই জরুরি।
তিনি আরও বলেন, সরকার ৫-১০ বছরের জন্য ওভেন খাতে আর্থিক প্রণোদনা দিলে বড় বড় অনেক শিল্প গড়ে উঠবে। এতে একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্যদিকে রফতানিতে মূল্য সংযোজনের পরিমাণও বাড়বে। শিগগিরই বিজিএমইএর পক্ষ থেকে বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়কে লিখিত আকারে জানানো হবে। বর্তমানে সরকারের মন্ত্রিসভায় অনেক ব্যবসায়ী মন্ত্রী আছেন। আশা করছি, তারা পোশাক খাতের বিদ্যমান সংকট বিবেচনায় নিয়ে আশু করণীয় নির্ধারণ করাসহ ভবিষ্যৎ পথনকশা প্রস্তুত করবেন।
এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, দেশীয় শিল্পের এ ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া কারও কাম্য নয়। আমরাও সেটি আশা করি না। বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব। ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেশীয় শিল্পের সুরক্ষায় বিদ্যমান নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংস্কার হতেই পারে। একই সঙ্গে বিদ্যমান নীতি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা ও হয়রানি কমানোর ব্যাপারেও তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান।
এ খাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক কাজ করছে। শিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা, মেশিনারিজ এমনকি কারিগরি ও ব্যবস্থাপক পর্যায়ের দক্ষ জনবলও আমদানি করতে হয়। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার লোকজন স্থানীয় গার্মেন্টগুলোর শীর্ষ পদে কাজ করছে। তার ওপর একদিকে বিদেশি ক্রেতারা পোশাকের দাম কমাচ্ছে, অন্যদিকে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে।
স্থানীয় চাপ- যেমন দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ। এছাড়া বন্দরে কনটেইনার জটের সমস্যা তো সারা বছর লেগেই আছে। এতে কারখানাগুলোতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসছে।
এই রেসে টিকতে না পেরে গত কয়েক বছরে শুধু বিজিএমইএভুক্ত প্রায় ১২শ’ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিক উল্টো অবস্থানে রয়েছে প্রতিযোগী দেশগুলো। নিজেদের তৈরি মেশিনারিজ ছাড়াও সব ধরনের নিজস্ব কাঁচামাল ও দক্ষ মানবসম্পদ থাকা সত্ত্বেও তৈরি পোশাক খাতে অবস্থান সুদৃঢ় করতে ভারত সরকার ৬ হাজার কোটি রুপির সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
টাকার অঙ্কে যা সাড়ে ৭ হাজার কোটি। ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া, এমনকি চীন সরকারও প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এক সময় বাংলাদেশ থেকে পোশাক শিল্প অন্য দেশে চলে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতি বছর রফতানি আয়ের যে তথ্য প্রকাশ করা হয় তা শুধুই ‘আইওয়াশ’। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করা হয়েছে বলে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্য প্রকাশ করেছে।
কিন্তু এই ৩১ বিলিয়ন ডলার রফতানির পেছনে কত কোটি ডলারের কাঁচামাল (ফেব্রিক্স, কেমিক্যাল, মেশিনারিজসহ আনুষঙ্গিক পণ্য) আমদানি করতে হয়েছে তা প্রকাশ করেনি। আমদানি হিসাব বাদ দিলে দেখা যাবে, প্রকৃতপক্ষে তৈরি পোশাক খাতের মূল্য সংযোজন ২০-৩০ শতাংশ হবে এবং সেটিই প্রকৃত রফতানির তথ্য।
মোট রফতানি আয়ের বড় অংশ আসে ওভেন খাত থেকে। অথচ এ তথ্য নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় ফেব্রিক্স উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় ফেব্রিক্স আমদানি দিনকে দিন বাড়ছে। রফতানি আয়ের বড় অংশই ফেব্রিক্স আমদানিতে ব্যয় হয়। এ খাতের ৮০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। অর্থাৎ ওভেন খাতে শুধু ‘দর্জিগিরি’ করে বাংলাদেশ।
এই দুর্নাম ঘোচাতে আন্তর্জাতিক মানের ফেব্রিক্স উৎপাদন করতে বেসরকারি সেক্টরের কয়েকজন স্বনামধন্য শিল্পোদ্যোক্তা এগিয়ে আসেন। গড়ে তোলেন একাধিক সুবৃহৎ টেক্সটাইল মিল। কিন্তু তাদের প্রটেকশন দেয়ার পরিবর্তে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের ওপর অসম প্রতিযোগিতার চাপ আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
উদ্যোক্তাদের মতে, নিট খাতের মতো ওভেন খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য উদ্যোক্তাদের প্রকৃতপক্ষে সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে। পাশাপাশি ওভেন ফেব্রিক্সে ১০ শতাংশ প্রণোদনা এবং গার্মেন্টগুলোকে স্থানীয় কাপড় ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে এ খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
তারা বলছেন, চীন ও ভারত সব দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এখনও প্রণোদনা অব্যাহত রেখেছে। অথচ দেশে রফতানির বিপরীতে শুধু ৪ শতাংশ ইনসেনটিভ দেয়া হয়। তাও পেতে ৩-৪ বছর ফাইলের পেছনে ঘুরতে হয়। দফতরে দফতরে টাকা খরচ না করলে ইনসেনটিভের টাকা পেতে আরও দেরি হয়।
স্পিনিং মিলগুলোর অবস্থা আরও বেগতিক। বিপুল অঙ্কের সুতা অবিক্রীত অবস্থায় গোডাউনে পড়ে আছে। এর ফলে উদ্যোক্তারা মিল চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। মূলত মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে সুতা আমদানি এবং বন্ডের কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি ও বিদেশি পোশাক স্থানীয় বাজারে বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশীয় সুতা বিক্রি হচ্ছে না।
বিটিএমএ (বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশন) বলছে, বর্তমানে স্পিনিং ও ফেব্রিক্স মিলগুলো উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে সুতা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অবস্থা এমনই বেগতিক যে, বেশির ভাগ মিল কর্তৃপক্ষ ঋণের কিস্তি ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না। এছাড়া সরকারের দেয়া ৪ শতাংশ বিকল্প নগদ সহায়তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অপ্রতুল।
ফলে সরকারের এই প্রণোদনা শিল্পে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ অবস্থা বহাল থাকলে মিলগুলো শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ তো দূরের কথা, আশঙ্কা করা হচ্ছে তারল্য সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সমস্যা মোকাবেলায় সম্প্রতি সরকারের কাছে ৫ দফা সুপারিশ করেছে বিটিএমএ। এগুলো হচ্ছে টেক্সটাইল মিলের জন্য কমপক্ষে ১০ বছর পর্যন্ত ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে রাখা, হ্রাসকৃত হারে কর আরোপের মেয়াদ ২০২৮ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা, দেশে তৈরি সুতা ও কাপড়কে ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্যের তালিকায় রাখা, নগদ সহায়তা ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ এবং মিথ্যা ঘোষণায় সুতা আমদানি বন্ধ ও বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত সুতার ওপর ‘নট ফর সেল’ লিখে সিল মারা।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, কোনো দেশ শিল্প বিপ্লব ছাড়া উন্নত বিশ্বের কাতারে নাম লেখাতে পারেনি। আজকের উন্নত প্রতিটি দেশেই শিল্প বিপ্লব ঘটিয়ে এই পর্যায়ে এসেছে। তাই বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে উন্নত দেশের কাতারে নাম লেখাতে হলে শিল্প বিপ্লব ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। কিন্তু বিদ্যমান পলিসি দিয়ে বিপ্লব তো দূরের কথা, এর ধারেকাছেও কিছু হবে না।
এজন্য সরকার ঘোষিত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বেসরকারি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি শিল্প প্রতিষ্ঠান কিভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে তার জন্য সব ব্যবস্থা করতে হবে। এটা ভাবলে হবে না যে, সরকারের সহায়তার কারণে ‘অমুক ব্যক্তি’ আরও কেন ধনী হয়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, শিল্প বিকাশের মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ে যত ধনীর র্যাংকিং বাড়বে, সামগ্রিকভাবে দেশ তত উন্নত হবে।
মাথাপিছু আয়ে উলম্ফন ঘটবে। এজন্য প্রণোদনা ও ঋণ পলিসিকে সামনের কাতারে আনতে হবে। শুধু মুখে নয়, বাস্তবে শিল্প উদ্যোক্তাদের হয়রানি বন্ধ করে সরকারি সহায়তার হাত প্রশস্ত করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং সেক্টরের বড় বড় জালিয়াত ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কারও জন্য পান থেকে চুন খসলে ফাঁসি, আবার কেউ ঘরের লোক হলে সাত খুন মাফ- এ রকম দ্বৈতনীতি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।