হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী রোববার (১৭ মার্চ)। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল গোপালগঞ্জের নিভৃত গ্রাম টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান একদিন বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি।
বাংলার রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের এ দিনে টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার মহানায়কের এ জন্মবার্ষিকী আজ রোববার জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে স্বাধীনতার জন্য উত্তাল ভারতের অগ্নিগর্ভে জন্ম নেন শেখ মুজিব। ব্রিটিশ আমলে শৈশব থেকেই শেখ মুজিব জমিদার, তালুকদার-মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতন দেখেছেন। মানুষের দুঃখ, কষ্ট দেখে তাদের মুক্তির সংগ্রামে তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।
ব্রিটিশ শাসন-শোষণের হাত থেকে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ মুক্ত হলেও বাঙালির উপর জেঁকে বসে পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসন-শোষণ। দীর্ঘ আন্দোলন আর লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিক পথ পেরিয়ে তিনি বাঙালিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। যার বর্হিপ্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে।
৭১-এর ৭ মার্চ তিনি ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার চূড়ান্ত নির্দেশ দেন। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তি সংগ্রাম, তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়েই প্রস্তুত থাক, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো-বঙ্গবন্ধুর এ চূড়ান্ত নির্দেশই জাতিকে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শক্তি ও সাহস জোগায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।
চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের তৃতীয় সন্তান। ৭ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন।
১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং বেকার হোস্টেলে আবাসন গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এ সময়ে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ওই সময়ে তিনি হোসেন সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শান্তি স্থাপনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসম সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
ভ্রান্ত দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরে এসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ তথা বাঙালি জাতি প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। তার উপর নেমে আসে জেল-জুলুম নির্যাতন।
রাজনৈতিক জীবনে এক যুগেরও অধিককাল তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। দুইবার তিনি ফাঁসির কাষ্ঠে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, ১৮ বার কারাবরণ করেছেন। পাকিস্তানি শাসক চক্রের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সব আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি করেছেন। ’৫২, ’৫৪, ’৬২, ’৬৬ আর ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়- সবই জাতির সংগ্রামী ইতিহাসের একেকটি মাইলফলক। আর এই সংগ্রামের নেতৃত্ব ও প্রেরণার উৎস ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় লাভের পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসেন।
দেশে এসেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্থাৎ দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের এ মহান স্থপতিকে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় মানবতার শত্রু, স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে।