বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) লাভের প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের খাতায় যেতে শুরু করেছে। সংস্থাটির ১৩ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এরই মধ্যে ৯টি লোকসানে চলে গেছে।
আরও একটি প্রতিষ্ঠান যাওয়ার পথে রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত তিন বছরে (২০১৫-১৬ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর) বিসিআইসি’র লাভের ৯টি প্রতিষ্ঠান লোকসান গুনেছে প্রায় সাড়ে ১৬শ’ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো কারখানা, চলতি মূলধনের ঘাটতি, গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত লাভের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ধুঁকছে। এমনকি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের অভাব রয়েছে। এসব কারণে প্রতিবছরই বাড়ছে লোকসানের পরিমাণ।
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চার সার কারখানাসহ ৮টি প্রতিষ্ঠানকে অত্যধিক লোকসানি হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিসিআইসি। কর্ণফুলী পেপার মিলসসহ ৪ প্রতিষ্ঠানে অদূর ভবিষ্যতে ব্যবস্থাপনা বা অন্য কোনো গুরুতর সমস্যা হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের পরিমাণও ক্রমাগত কমছে। বছরের পর বছর এভাবে চলতে থাকলে দেশের সর্ববৃহৎ পাবলিক কর্পোরেশনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সর্বশেষ অর্থবছরে সার কারখানাসহ ৯ প্রতিষ্ঠানে লোকসানের পরিমাণ ৬৯৬ কোটি টাকা। অন্য চার প্রতিষ্ঠানের লাভ হিসাব করলেও বিসিআইসি’র লোকসানের পরিমাণ ৬২১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯ প্রতিষ্ঠানে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৬৪১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। অন্য চার প্রতিষ্ঠানের লাভ হিসাব করলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১০৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। টানা তিন বছর ধরে লোকসানে থাকা বিসিআইসি ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও ১৩ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে লাভ করেছিল ৭৮ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে লাভের পরিমাণ ছিল ২১৭ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল হালিম গণমাধ্যমকে বলেন, বিসিআইসি’র প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই সার কারখানা। সেখানে ইউরিয়া সার উৎপাদন করা হয়। এখানে বেশ কয়েকটি কারখানা আছে অনেক পুরাতন। এ কারণে ইউরিয়া সার উৎপাদন করতে কাঁচামাল হিসেবে বেশি গ্যাসের প্রয়োজন হয়। লোকসানের পরিমাণ কমিয়ে আনতে শিল্প মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কম খরচে বেশি সার উৎপাদন করতে ঘোড়াশাল ও পলাশ সার কারখানায় একটি বড় প্রকল্প চলমান রয়েছে। অন্যান্য যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধানেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আবার লোকসান যেভাবে বলা হচ্ছে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে সেটি আবার লোকসান নয়। কেননা সার আমরা সরকার বা কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করে থাকি।
তিনি আরও বলেন, বিসিআইসি’র কর্ণফুলী পেপার মিল অনেক লোকসান গুনছিল। সরকারের চিন্তা ছিল এই কারখানাটি বন্ধ করে দেয়া হবে। পরে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে লোকসানের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিসিআইসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন ৮টি সার কারখানার মধ্যে পাঁচটিই লোকসানে রয়েছে।
লাভে থাকা যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের লাভের পরিমাণ প্রতিবছর কমছে। সর্বশেষ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লাভ করেছে ২২ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
২০১৫-১৬ অর্থবছরেও প্রতিষ্ঠানটির লাভের পরিমাণ ছিল ১৭০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তবে ডিএটি ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে লাভের পরিমাণ বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লাভ করেছিল ২৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটিতে লাভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিসিআইসি’র বাণিজ্যিক কারখানাগুলোর আয়ুষ্কাল ও ক্রমশ ডাউন টাইম বৃদ্ধি পেয়েছে। অবহেলা ও তদারকির অভাবে যথাসময়ে কারখানাগুলো ওভারহোলিং কিংবা বিএমআরই হয়নি। সারা বছরই পর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘাটতি থাকে। বিসিআইসি’র বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সেখানে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনেও লোকসানের কারণ হিসেবে এসব বিষয় উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে এর বাইরে, কারখানাগুলোর উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, খুচরা যন্ত্রাংশ ও মেরামত খাতে ক্রমশ ব্যয় বৃদ্ধি এবং গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিকেও লোকসানের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অত্যধিক লোকসানি ৮ প্রতিষ্ঠান : ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিসিআইসি’র একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লোকসানে থাকা বিসিআইসি’র ৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮টিকে অত্যধিক লোকসানি প্রতিষ্ঠান বলছে বিসিআইসি। প্রতিষ্ঠানগুলো হল শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড, ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড, কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড, আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড, ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্সুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে প্রতিবছর বাড়ছে লোকসানের পরিমাণ। সর্বশেষ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটিতে লোকসান হয়েছে ২৮৭ কোটি ৮৪ কোটি টাকা। ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী লিমিটেডেরও একই অবস্থা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লাভ করেছিল ৬০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। অথচ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসানের পরিমাণ ১৩৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেডেও প্রতিবছর বাড়ছে লোকসানের পরিমাণ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটিতে লোকসানের পরিমাণ ছিল ৩১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (এমটিএস) রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, সার কারখানাগুলোতে লোকসানের কারণ হচ্ছে শুধু উৎপাদনের দায়িত্ব কারখানার। কিন্তু দাম নির্ধারণ করে সরকার। আর অন্যান্য কারণের মধ্যে এ কারখানাটি স্থাপিত হয়েছে ষাটের দশকে। তাছাড়া কাঁচামালের ঘাটতির কারণে কিছুটা সমস্যা হয়।
ঝুঁকিতে রয়েছে কর্ণফুলী পেপার মিলসহ ৪ প্রতিষ্ঠান : বিসিআইসি’র পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অদূর ভবিষ্যতে ব্যবস্থাপনা বা অন্য কোনো গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে অতি লোকসানে থাকা চারটি প্রতিষ্ঠানে। এগুলো হল কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেড, ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্সুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারিওয়্যার ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড। এ ৪টি প্রতিষ্ঠান ক্রমাগত লোকসান গুনছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কর্ণফুলী ২৭ কোটি ৮৭ লাখ, ছাতক সিমেন্ট ৪১ কোটি ৭৬ লাখ, বাংলাদেশ ইন্সুলেটর ৫১ লাখ এবং উসমানিয়া গ্লাস শিট ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে। এ বিষয়ে কর্ণফুলী পেপার মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএমএ কাদের কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘সমস্যার শেষ নেই। অনেক সমস্যা।’