বিশ্বের দূষিত নদীর শীর্ষ পাঁচের তালিকায় বুড়িগঙ্গার নাম আগেই উঠেছে। সরকারি হিসাবেও দেশের সবচেয়ে দূষিত নদী বুড়িগঙ্গা। কিন্তু সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বুড়িগঙ্গার চেয়ে তুরাগ ও ধলেশ্বরীর দূষণ বেশি পাওয়া গেছে। এই দুই নদীর তীরে শিল্পকারখানা ও আবাসন প্রকল্পের ঢল নামায় সেখানে দূষণ কয়েক বছর ধরে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। নদী রক্ষাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় তুরাগ ও ধলেশ্বরীর দূষণের তীব্রতার তথ্য উঠে এসেছে।
ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, দূষিত নদীর তালিকায় তুরাগের অবস্থান শীর্ষে। এরপর ধলেশ্বরী, তারপর বুড়িগঙ্গা। তুরাগের তীরে ডায়িং ও ভারী শিল্প এবং ধলেশ্বরীর তীরে নতুন চামড়াশিল্প নগরী গড়ে ওঠার পর দূষণের পরিমাণ বেড়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণাতেও দেখা গেছে।
ওয়াটার কিপারসের সমীক্ষা বলছে, রাজধানীর চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরী, বংশী ও শীতলক্ষ্যার তীরে যারা বাস করে, তারা সেখানকার পানি পান করে না। অধিবাসীদের ৫৭ শতাংশ বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে। ৮০ শতাংশ ভূগর্ভের পানি ও ২০ শতাংশ ওয়াসার সরবরাহ করা পানি ব্যবহার করে।
অথচ সেখানে তাদের আগের প্রজন্ম বসতি গড়েছিল ওই নদীগুলোকে কেন্দ্র করে। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে এখানকার অধিবাসীরা খাওয়া, গোসল ও রান্নার জন্য নদীর পানি ব্যবহার করত। বর্তমানে তারা গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভের পানি তুলে তা ব্যবহার করে। সম্প্রতি ভূগর্ভের পানিতেও তারা দূষণ ও দুর্গন্ধ পাচ্ছে বলে সমীক্ষায় তথ্য উঠে এসেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওয়াটার কিপারস বাংলাদেশের সমন্বয়কারী শরিফ জামিল গণমাধ্যমকে বলেন, মূলত অনিয়ন্ত্রিতভাবে এসব নদীর তীরে দূষণকারী শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। এসব কারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলোর কোনো উদ্যোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে একসময় এসব নদীর তীরে কারও পক্ষে বসবাস করা সম্ভব হবে না।
সমীক্ষাটির জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর কাঁচপুর সেতুর নিচে, বুড়িগঙ্গার শ্যামপুর ও হাজারীবাগ অংশে, ধলেশ্বরীর নতুন চামড়াশিল্প নগরী অংশে ও সাভার বাজার অংশে, বংশী নদীর পাশে সাভার ইপিজেড এলাকা ও আশুলিয়ায় তুরাগ নদ থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরের বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করা ওই নমুনায় পানির অম্লত্বের পরিমাণ, দ্রবীভূত বস্তুকণার পরিমাণ, তাপমাত্রা ও ইলেকট্রিক কনডাকটিভিটি বা বিদ্যুৎ পরিবাহিতার মাত্রা পরিমাপ করা হয়।
পানির মানমাত্রার এসব সূচকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ পরিবাহিতা। কারণ, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকলে এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বেশি থাকলে বিদ্যুৎ পরিবাহিতা বেশি থাকে। সমীক্ষাটিতে দেখা গেছে, তুরাগে বিদ্যুৎ পরিবাহিতা প্রতি সেন্টিমিটারে ১ হাজার ১৫৭ মাইক্রো সিমেন্স, ধলেশ্বরীতে ১ হাজার ৯৫, বুড়িগঙ্গায় ১ হাজার ৬৮। বিদ্যুৎ পরিবাহিতা বংশী নদীতে সবচেয়ে কম—প্রতি সেন্টিমিটারে ১৬২ মাইক্রো সিমেন্স। এ ছাড়া শীতলক্ষ্যায় প্রতি সেন্টিমিটারে ১ হাজার ৬৮ সিমেন্স।
এই সমীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তুরাগের তীরে মারাত্মক দূষণকারী শিল্পকারখানা বেশি করে গড়ে উঠছে। এসব কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র (ইটিপি) সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। আর ধলেশ্বরীর পাশে যে চামড়াশিল্প নগরী গড়ে উঠেছে, সেখানে ইটিপি থাকলেও তাতে কারিগরি ত্রুটি আছে। ফলে ওই দুই নদীতে দূষণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। আমরা দূষণ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’