বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৫ গুণ

অর্থনীতি ডেস্ক

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। সরকারের সর্বশেষ তথ্যানুসারে আগামী জুন শেষে দেশের প্রত্যেক মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ১ হাজার ৯০৯ ডলারে। কিন্তু ১৯৭২ সালে এর পরিমাণ ছিল ১২৯ ডলার। এ হিসাবে স্বাধীনতার পর গত ৪৮ বছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৫ গুণ বেড়েছে।

তবে এর চেয়েও বেশি উন্নয়ন হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে। শিক্ষার হার, জন্মনিয়ন্ত্রণ, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধসহ সামাজিক সূচকগুলোতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। কোনো ক্ষেত্রে ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বিশ্বে ৩৩তম।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দু’টি কারণ। প্রথমত, পাকিস্তান থেকে রাজনৈতিক মুক্তি এবং দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক মুক্তি। পাকিস্তান আমলে উন্নয়নবঞ্চিত ছিল এ দেশ। তাদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি। এটি অত্যন্ত সম্ভাবনার দিক। আর এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের রোড মডেল।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, জাতি হিসেবে বাঙালি অনেক মেধাবী। কিন্তু পাকিস্তান সরকার কোনো সুযোগ দেয়নি।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। ৪০ শতাংশ খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। কিন্তু খাদ্য আমদানি করতে হয় না। এ ছাড়া শিল্প খাতের অনেক উন্নয়ন হয়েছে।

বর্তমানে গার্মেন্ট শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। চীনের পরেই আমাদের অবস্থান। একই অবস্থা সেবা খাতেও। তার মতে, বৈষম্যের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে আমাদের পিছিয়ে রাখা হয়েছিল।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় কত ছিল তার স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। যুদ্ধকালীন সময়ে এ ধরনের পরিসংখ্যান তৈরির কাজও হয়নি। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। আর আগামী জুন শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৯০৯ ডলারে উন্নীত হবে বলে সরকারি তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হিসাবে আলোচ্য সময়ে মাথাপিছু আয় ১৫ গুণ বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে যেসব দেশে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার, তারা মধ্যম আয়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ ডলার পর্যন্ত হলে তারা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হবে।

৪ হাজার ১২৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার মাথাপিছু আয় হলে ওই দেশগুলোকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ধরা হয়। এর চেয়ে বেশি মাথাপিছু আয় হলে সেই দেশগুলোকে বলা হয় উচ্চ আয়ের দেশ। এই হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ।

অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মে দেশের মোট কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের উৎপাদনের সঙ্গে রেমিটেন্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) যোগ করে মোট আয় বের করা হয়। এই মোট আয়কে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। এ হিসাবে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রেমিটেন্সের বড় ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে তিন বছর আগে ২০১৫-১৬ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৪৬৬ ডলার। এ হিসাবে দু’বছরে আয় বেড়েছে ৪৪৩ ডলার। শতকরা হিসাবে যা প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু দু’বছর আগেও করমুক্ত আয়সীমা ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এখনও ওই সীমা বহাল আছে।

এরপরও করদাতা বেড়েছে মাত্র ১ লাখের কিছু বেশি। অন্যদিকে জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশে কর আদায় মাত্র ১০ শতাংশ। ভারতে তা ১৮ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১৬, চীনে ২৯, মালদ্বীপে ২১, পাকিস্তান ১৭, নেপালে ২৪ এবং সিঙ্গাপুরে ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও কর জিডিপি অনুপাতে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

অন্যদিকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা ২৭৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় সামাজিক বেশকিছু সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রাপ্তির হিসাবে বাংলাদেশ বেশি এগিয়ে রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের প্রতি হাজারে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। ভারতে এই হার ৪৩ ও পাকিস্তানে ৭৯ জন। একইভাবে বাংলাদেশে ৯৮ ভাগ শিশু প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব শেষ করছে। ভারতে তা সমান হলেও পাকিস্তানে ৭২ ভাগ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছে। আয়ুষ্কালের দিক থেকেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর। ভারতে তা ৬৮ বছর আর পাকিস্তানে ৬৬ বছর। এ ছাড়া বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর পাকিস্তানে দারিদ্র্যের হার ২৯ দশমিক ৫ শতাংশ।

জানা গেছে, বতর্মানে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে অন্তত ৭ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। দেশটির রিজার্ভের অর্থ দিয়ে মাত্র ২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেতে পারে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এগিয়ে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে আমাদের স্থিতিশীলতা সন্তোষজনক। বিখ্যাত সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস ১১টি উদীয়মান দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ রয়েছে এ তালিকায়। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাচ্ছে।

স্বাধীনতার মাত্র চার দশকেই বাংলাদেশ অবিশ্বাস্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বিস্ময়করভাবে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ১৯৭১ সালে শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল।

তিনি বলেন, এখনও দেশের প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। এই দুর্নীতি রোধ করতে হবে। পাশাপাশি সর্বজনীন সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। এই দু’টি বিষয় সফলভাবে করতে পারলে বিশ্বে সব ক্ষেত্রে রোল মডেল হবে বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে