অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ : মুজিবনগর সরকারের একমাত্র জীবিত উপদেষ্টা

মোনায়েম সরকার

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার


“২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করলে তিনি সেই পদক নিতে অস্বীকৃতি জানান। তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছি দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, পদকের জন্য নয়।”

-মোনায়েম সরকার

আমার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে যাদের স্নেহ-ভালোবাসা ও আন্তরিক স্পর্শে ঋদ্ধ হয়েছি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ তাদের অন্যতম। মোজাফফর আহমদের জন্ম ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল, কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলায়। জন্মসূত্রে তিনি এবং আমি একই মাটির সন্তান। আমি শৈশব থেকেই মোজাফফর আহমদের নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। আমার সেজ ভাই আবদুল খালেক সরকার তখন বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার সূত্রেই আমি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের জীবন ও কর্ম সম্পর্ক অবগত হই। এরপর ধীরে ধীরে তার ঘনিষ্ঠ সাহচার্যে আসি। দীর্ঘদিন আমরা একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। আন্দোলন-সংগ্রামে লড়াই করেছি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তার সঙ্গে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছি।

আমার শৈশব কাটে কুমিল্লায়। কৈশোরে পদার্পণ করেই চলে আসি ঢাকার কাকরাইলে। ৭৮ নং কাকরাইলে আমাদের বাসা ছিল। মোজাফফর আহমদ তখন থাকতেন ৫০ কাকরাইলের একটি বাড়িতে। তার বাড়ির সামনের আরেকটি বাড়ি থেকেই তখন প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকা। পাশাপাশি বসবাস করার ফলে আমাদের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়। আস্তে আস্তে আমার চেতনায় অঙ্কুরিত হয় বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা। যৌবনে এই রাজনীতিতেই দীক্ষা নিই। বাম-প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠার সময়ই আকৃষ্ট হই অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের চারিত্রিক ও রাজনৈতিক আদর্শে। মোজাফফর আহমদের সূত্র ধরেই সেই সময় আমার মেজ ভাইয়ের বাসায় আসেন কমরেড মণি সিং, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, বারীণ দত্তসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। একসাথে আমরা দীর্ঘকাল পথ চলেছি। তারপর একসময় আমাদের পথ দুইদিকে সঙ্গত কারণেই বেঁকে যায়। আমি যোগ দেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে, তিনি থেকে যান তার পূর্বের জায়গায়। তার কাছে জীবনে আমি অনেক কিছু শিখেছি। তার ভালোবাসা অতুলনীয়। বাংলাদেশের বাম-রাজনীতির ইতিহাসে অন্যান্য বাম-রাজনীতিকের মতো অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নামও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

অধ্যাপক সাহেবকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। এই ছোট্ট লেখায় হয়তো সেসব কথা বলা সম্ভব নয়, তবু যতটুকু পারি বলার চেষ্টা করবো। মোজাফফর আহমদ অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তার বিষয় ছিল অর্থনীতি। রাজনীতির প্রতি প্রবল ভালোবাসার কারণেই তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে যুক্ত হন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হন। পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে তিনি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী (মুসলিম লীগ প্রার্থী) মফিজউদ্দীনকে হারিয়ে বিজয়ী হন। মূলত এই বিজয়ের পরেই তিনি দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান পাকাপোক্ত হয়।

আইয়ুব খান যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন, তখন আইয়ুব খানের পুরো সময় জুড়ে মোজাফফর আহমদ আত্মগোপন করে থাকেন। সে সময় তিনি দিনের বেলা লুকিয়ে থাকতেন, রাতের বেলা লুঙ্গি পরে ব্যাগ হাতে বের হতেন। পুলিশে ধরলে জবাব দিতেন প্রেসের কম্পোজিটর হিসেবে কাজ করেন। পুলিশ তাকে ছেড়ে দিতো। একজন মানুষের দেশপ্রেম ও রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা এই ঘটনা দিয়েই কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে।  

প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত এক কাউন্সিল অধিবেশনের পর চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন খান আবদুল ওয়ালী খান। মস্কোপন্থী শিবিরের পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশই পরে ‘ন্যাপ মোজাফফর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানে অবশ্য বলে রাখা দরকারÑ আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে গিয়ে ভাসানী সাহেব ন্যাপ সৃষ্টি করেছিলেন। ন্যাপের সৃষ্টিলগ্নে মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট ছিলেন, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন যুগ্ম-সম্পাদক।

ভাসানী যখন ইউরোপ যান তখন ফেরার পথে কোলকাতায় তারা কয়েকজন আটকা পড়েন। তাদের মধ্যে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদও ছিলেন। এ সময় অধ্যাপক সাহেবের সহধর্মিনী আমিনা আহমদ তাকে দেখতে কলকাতায় যান। সেখানে গিয়ে টের পান তিনি সন্তান সম্ভাবনা। ওই পরিস্থিতিতে অধ্যাপক সাহেব ও তার স্ত্রী সন্তান নিয়ে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অর্থাৎ সন্তান না রাখার পক্ষেই তাদের ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ইলা মিত্র আর তার স্বামী রমেন মিত্রের হস্তক্ষেপে যে সন্তান কলকাতায় জন্ম নেয় সে-ই আমাদের সবার প্রিয় ¯েœহভাজন আইভি। বর্তমানে আইভি যেভাবে তার পিতার সেবায় দিনরাত শ্রম দিয়ে যাচ্ছে তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আইভির মতো সেবাময়ী কন্যা যে পিতার ঘরে জন্ম নেয়, সে পিতা ধন্য।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিব নগর সরকার আট সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল। এই আট সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদও ছিলেন। এই উপদেষ্টা পরিষদে আরো ছিলেন- মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর, খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রমুখ। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তার নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

আমেরিকা যখন  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, এ খবর শুনে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা মওলানা ভাসানীর বাসায় মিটিং করার জন্য মিলিত হয়। ভাসানী উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের পদ্মার ইলিশ মাছ খাওয়ানোর জন্য নিজেই মাছ ভাঁজতে থাকেন। সেসময় মোজাফফর আহমদের সঙ্গে স্থপতি মজহারুল ইসলাম, জাকির আহমেদ ও আমি ভাসানীর বাসায় যাই। তখন আমরা সকলেই কলকাতার বাসিন্দা। মোজাফফর সাহেবকে সে সময় বেশ চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। মোজাফফর সাহেবের চিন্তিত মুখ দেখে মওলানা ভাসানী বললেন, ‘অত চিন্তা কইরো না মোজাফফর। তুমি আমি চিন্তা কইরা কিছু করতে পারবো না, যা করার জওহরলালের বেটিই করবো।’ সেদিনই বুঝেছিলাম ভাসানী কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন এবং তিনি মোজাফফর আহমদকে কতখানি স্নেহ করতেন।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলোর বেশিরভাগই সমাজতন্ত্রের রূপরেখা সম্পর্কিত। গ্রন্থগুলো আমরা নিজেরাও পড়েছি এবং অন্যদেরও পড়তে উৎসাহিত করেছি। তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ হলো : ‘সমাজতন্ত্র কি এবং কেন’, ‘প্রকৃত গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা’, মাওবাদী সমাজতন্ত্র ও কিছু কথা’, ‘আত্মজীবনী’ ইত্যাদি। এইসব গ্রন্থে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের চিন্তাশীল মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে দেশ যখন নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত তখন ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের সম্ভাবনা তৈরি হয়। নানা কারণে সেই ত্রিদলীয় ঐক্যজোট ভেঙে যায় এবং পরবর্তীতে বাকশাল গঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে বাকশাল দিকভ্রান্ত হয়। অনেকেই আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যান। কেউ কেউ কোদাল নিয়ে নেমে পড়েন খাল কাটতে। ন্যাপও সে সময় ঠিক মতো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। কথাটা কটু শোনালেও এটাই ছিল সে সময়ের বাস্তবতা। আমার দল ও মত পরিবর্তন করার এটাও একটা প্রধান কারণ ছিল।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ রাজনীতি করেছেন দেশের মানুষের সেবা করার জন্য, ব্যক্তিগত সুখভোগের জন্য নয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করলে তিনি সেই পদক নিতে অস্বীকৃতি জানান। তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছি দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, পদকের জন্য নয়। সেদিন তার প্রতিক্রিয়ায় কে কি ভেবেছেন জানি না, তবে আমরা যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছি, তারা জানি তার এই অভিব্যক্তি নিছক লোক দেখানো নয়। তার এ কথার মধ্যে আছে গভীর দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম।

দোষেগুণেই মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে আমি যেটুকু জেনেছি, চিনেছি তাতে আমার মনে হয়েছে তার মতো রাজনৈতিক নেতার কাছে এ প্রজন্মের নেতাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আজীবন তিনি নীতিতেই অটল ছিলেন, দেশের স্বার্থ বড় করে দেখতেন এবং মানুষের সেবা করতে পারলে খুশি হতেন।

আজ তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাশায়ী। আমি কয়েকবার তাকে দেখতে গিয়েছি তার মেয়ের বারিধারার বাসায় ও হাসপাতালে। একদিন প্রাক্তন সংসদ সদস্য আমিনা ভাবি শয্যাশায়ী অধ্যাপকের কানে কানে বললেন, মোনায়েম এসেছে চিনতে পারছো? অধ্যাপক সাহেব জোর গলায় বললেন, মোনায়েমকে চিনবো না তো কাকে চিনবো। তার কথায় সেদিন আমার বুক ভরে ওঠেছে। অনেক কিছু ভুলে গেলেও তিনি যে আমাকে মনে রাখতে পেরেছেন এটাই আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। আমি তার সুস্থতা ও শতায়ু কামনা করি।

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে