এফ আর টাওয়ারে আগুন: ভূমি মালিকসহ দু’জন গ্রেফতার

ডেস্ক রিপোর্ট

বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড
বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ড। ফাইল ছবি

রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ২৩ তলাবিশিষ্ট এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল শনিবার মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে ভবনটির ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল, জমির মালিক ইঞ্জিনিয়ার এস এম এইচ আই ফারুক হোসেন এবং ভবনটিতে অবৈধভাবে নির্মিত বর্ধিতাংশের মালিক তাসভির উল ইসলামকে। এর মধ্যে গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বারিধারার বাসা থেকে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তাসভিরকে এবং রাত সোয়া একটার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ফারুক হোসেনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি মোস্তাক আহমেদ খান গতকাল রাতে বলেন, ভবনটির জমির মালিক ফারুক হোসেন, ডেভেলপার রূপায়ণ গ্রুপের কর্ণধার লিয়াকত আলী খান ও তাসভির উল ইসলামসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা হয়েছে। জানা গেছে, অজ্ঞাত আসামিদের মধ্যে ভবন পরিচালনা কমিটির নেতাসহ অনেকের নাম রয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে দণ্ডবিধির ৩০৪(ক), ৪২৭, ৪৩৬ ও ১০৯ ধারায় এ মামলা করেছে। অবহেলার কারণে মৃত্যু, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও অপরাধজনক অগ্নিকাণ্ডের ধারায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান জানান, তাসভির ও ফারুক হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত করছে ডিবি। এতে যারাই দায়ী হবেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, মামলার অপর আসামি রূপায়ণ গ্রুপের চেয়ারম্যানকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ে ভবনটির জমির মালিক ইঞ্জিনিয়ার ফারুক হোসেন ও রূপায়ণ গ্রুপ যৌথভাবে নকশা অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন। তখন ১৮ তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের জন্য নকশা অনুমোদন করা হয়। যৌথ মালিকানা হওয়ায় ভবনটির নাম তখন দেওয়া হয় ফারুক-রূপায়ণ টাওয়ার- সংক্ষেপে এফ আর টাওয়ার। ১৮ তলা তৈরির অনুমোদন থাকলেও ভবনটি ২৩ তলা করা হয়েছে। ওপরের পাঁচ তলাই অবৈধভাবে নির্মাণ করা। অবৈধ ফ্লোরগুলোর মালিক তাসভির উল ইসলাম। পাশাপাশি তিনি কাশেম ড্রাইসেল কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নির্বাহী কর্মকর্তা।

এফ আর টাওয়ারের ম্যানেজার মোজাম্মেল হোসেন গতকাল বলেন, ভবনটির যৌথ মালিকানা রয়েছে। ৫৫ শতাংশের মালিক ডেভেলপার কোম্পানি রূপায়ণ গ্রুপ। আর ৪৫ শতাংশের মালিক ভবনটির জমির মালিক।

এদিকে বনানীর অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, ওই ভবনের নকশায় ত্রুটি ছিল। তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলছেন, বহুতল ভবন হিসেবে সেখানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। জরুরি বহির্গমনের পথও অত্যন্ত সরু।

কেন ভবনটি অনিরাপদ ছিল- এমন প্রশ্নে অনেকেই বলছেন, এ বিষয়ে জমির মালিক, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও রাজউক দায় এড়াতে পারে না। তবে রাজউক বলছে, ভবনটির অনুমোদন ছিল ১৮ তলার, সেটি ২৩ তলা পর্যন্ত উঠে গেছে। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী একই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, গত ১৪ বছর বিষয়টি জেনেও কেন রাজউক চুপ করে ছিল?

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামও বলছেন, বহুতল ভবনে অনিয়মের ব্যাপারে তারা এখন জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করবেন। এখন আর কথা বলার সময় নেই। এখন অ্যাকশনের সময়।

সরজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর বনানীতে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর ২৩ তলাবিশিষ্ট এফ আর টাওয়ারের জরুরি বহির্গমন (ইমার্জেন্সি এক্সিট) সিঁড়ির প্রস্থ মাত্র ২৪ ইঞ্চি। দুর্ঘটনার সময় এই সংকীর্ণ সিঁড়িটিই রাখা হয়েছে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য। তবে প্রয়োজনে তা কাজে এলো না। গত বৃহস্পতিবার এই ভবনে অগ্নিকাণ্ডের দিন অধিকাংশ তলায় সিঁড়িটি ছিল বন্ধ। যেখানে ২৯টি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন নয় শতাধিক লোক। এ ধরনের একটি বহুতল ভবনে এত সরু এক্সিট সিঁড়ি রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল শনিবার একাধিক তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তারাও ভবনের ইমার্জেন্সি এক্সিট সিঁড়ি ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আজ রোববার তদন্ত কমিটি গণশুনানি করবে। দুর্ঘটনাস্থলে স্থাপিত পুলিশ কন্ট্রোল রুমে এই শুনানিতে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা ও বক্তব্য শোনা হবে।

শনিবার সকাল ১১টার দিকে প্রথমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা পোড়া ভবনটিতে ঢোকেন। এরপর সেখানে যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমিটির সদস্যরা। বহুতল ওই ভবনে গত বৃহস্পতিবার অগ্নিকাণ্ডের পর ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফয়জুর রহমানের নেতৃত্বে বুয়েট, ঢাকা জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও আর্মড ফোর্সেসের প্রতিনিধিসহ নয় সদস্যের তদন্ত দল এফ আর টাওয়ারে প্রবেশ করে।

পরিদর্শন শেষে ফয়জুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ভবনের ৮, ৯ ও ১০ তলায় আগুনে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে কীভাবে আগুন লেগেছে, ঠিক কোন জায়গা থেকে লেগেছে, তা এখনও বলতে পারছি না। যেসব ফ্লোরে গিয়েছি, সেখানে দেখেছি অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রী অকার্যকর ছিল।

তিনি আরও বলেন, ৩ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আশা করছি। আজ সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ঘটনার সময় ৮, ৯ ও ১০ তলায় যারা ছিলেন, তাদের কথা শুনব। তারা হয়তো আগুন লাগার কারণ বলতে পারবেন। ভবনের মূল মালিক এস এম এইচ আই ফারুকের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত অব্যাহত রাখবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি শিকদার বলেন, ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়িটি খুবই সরু। এত বড় ভবনের জন্য যা মোটেও যথেষ্ট নয়। ওপরের তলায় গিয়ে দেখলাম, বেশি মানুষ নিহত হওয়ার কারণ হচ্ছে এই সরু সিঁড়ি। সিঁড়িটির প্রস্থ মাত্র ২৪ ইঞ্চি। বিভিন্ন ফ্লোর মালিকরা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন যেভাবে করেছেন, তাতে করে লোকজনকে একতলা থেকে অন্য তলায় যেতে সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। ভবনের টেম্পার নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আমরা বুয়েটের তদন্ত দলের জন্য অপেক্ষা করছি। তারা এসে ভবন পরীক্ষার পর আমরা বলতে পারব, ভবনটি কতটা ঝুঁকিতে আছে।

ইমার্জেন্সি এক্সিট সিঁড়ির ব্যাপারে তদন্ত কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। একজন জানালেন, সিঁড়িটির প্রস্থ ২৪ ইঞ্চির মতো। আরেকজন জানালেন, ২৮ থেকে ৩০ ইঞ্চি হতে পারে। মোটকথা, সিঁড়ির প্রস্থ কোনোভাবেই দুই থেকে আড়াই ফুটের বেশি নয়। এত বড় ভবনে এত ছোট এক্সিট সিঁড়ি কেন রাখা হয়েছে, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলেন দু’জনেই।

আগুন লাগার পর থেকে এফ আর টাওয়ারের সামনের কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর একটি অংশে যান চলাচল এখনও বন্ধ রয়েছে। পেছনের ১৭ নম্বর সড়কেও যান চলাচল বন্ধ। তবে গতকাল অনেকে এসে এফ আর টাওয়ারের পার্কিংয়ে থাকা তাদের মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার নিয়ে গেছেন।

এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত অন্য দুই তদন্ত কমিটি কার্যক্রম শুরু করেছে। এফ আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদন এবং নির্মাণ-সংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে দেখা হবে তাদের মূল কাজ। গতকাল শনিবার তদন্ত কমিটির সদস্যরা রাজউক কনফারেন্স হলে প্রথম বৈঠক করেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ভবনটি নির্মাণের সময় অনুমোদনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের চিহ্নিত করা, অনুমোদনে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি-না, হলে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে, তলার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে কি-না এ ধরনের বিষয় খুঁজে দেখবে কমিটি। এ জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাজউকের কাছে চাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠকে উপস্থিত কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন। তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। রাজউকের কাছ থেকে কাগজপত্র পাওয়ার পর শিগগির আবারও বৈঠক হবে বলে জানান তিনি।

এফ আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদন ও নির্মাণ-সংক্রান্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি তদন্তে কাজ শুরু করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। এ কমিটি ভবনটির মালিক পক্ষকে ভবন সম্পর্কিত তথ্যসহ দুই দিনের মধ্যে সাক্ষাৎ করার জন্য নোটিশ দিয়েছে। কীভাবে ভবনটি অনুমোদন পেয়েছে, সেখানে কোনো অনিয়ম ছিল কি-না, কারা অনুমোদন দিয়েছেন, সব কিছুই খতিয়ে দেখা হবে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে