কুমিল্লায় অভাবের তাড়নায় ৫ মাস বয়সী ইয়াছিন নামের এক ছেলে শিশুকে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বাবার বিরুদ্ধে। দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের বারুর গ্রামের পূর্বপাড়া মুন্সি বাড়িতে এ ঘটনাটি ঘটেছে।
সোমবার সকালে ওই গ্রামে গিয়ে এর সত্যতা পাওয়া যায়।
ওই বাড়িতে সাংবাদিকদের উপস্থিত দেখে সন্তানকে ফিরে পেতে বুকফাটা আর্তনাদে ফেটে পড়েন ওই হতভাগা ছেলের মা বিলকিস বেগম (৩৫)।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন। আমার সন্তানকে আমার স্বামী দালালের মাধ্যমে দুই লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে।
সন্তানহারা বিলকিস বেগম বলেন, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একটি মাইক্রোবাসযোগে কয়েকজন লোক আসলে, আমার কোল থেকে জোরপূর্বক আমার ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের নিকট দিয়ে দেয় আমার স্বামী। আমি অনেক আকুতি মিনতি করেও আমার সন্তানকে আগলে রাখতে পারিনি।
তিনি বলেন, সন্তান দিতে না চাইলে, আমার স্বামী আমাকে মারধর করে সন্তানকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। শুনেছি আমার স্বামী চরবাকর গ্রামের বলিমন্দের বাড়ির নূরুল ইসলামের মাধ্যমে দুই লাখ টাকায় আমার সন্তানকে বিক্রয় করে দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সন্তানকে কোথায় বিক্রি করেছে জানি না। আমার স্বামী জুয়ারি, জুয়া খেলে এখন প্রায় সর্বশান্ত। তাই অভাবের তাড়নায় আমার সন্তান বিক্রি করেছে। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও আমি আমার সন্তান ফিরে পেতে চাই।
এদিকে বিলকিসের অভিযুক্ত স্বামী সেলিম মিয়া (৪৫) বলেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে ২২ বছর আগে। অভাবের সংসার, স্ত্রী ও ৫ পুত্র ১ কন্যা নিয়ে সংসারের ভরণ-পোষণ খুবই কষ্ট হচ্ছে। তাই চরবাকর গ্রামের ব্যবসায়ী নূরুল ইসলামের মাধ্যমে আমার সন্তানকে কুমিল্লায় এক নিঃসন্তান পরিবারের নিকট দত্তক হিসেবে দিয়েছি। তবে আমি কোনো টাকা পয়সা নিয়ে সন্তানকে বিক্রি করিনি। আমার সন্তান ভালো থাকবে, লেখাপড়া শিখবে, মানুষের মতো মানুষ হবে। এজন্যই দত্তক দিয়েছি।
শিশুটিকে দত্তক দিতে সহায়তাকারী চরবাকর গ্রামের ব্যবসায়ী নূরুল ইসলামের নিকট কোথায় সন্তান দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সন্তান বিক্রি করা হয়নি, ওই পরিবারের সম্মতি নিয়েই কুমিল্লায় এক নিঃসন্তান শিক্ষক পরিবারের নিকট দত্তক দিয়েছি।
তবে ওই পরিবারের পরিচয় সে জানে না, এমনকি নামও জানেন না। তবে একটি সেল ফোন নম্বর দিয়ে বলেন, এটাই আছে।
পরে ওই সেল ফোনে যোগাযোগ করে জানা গেছে ভিন্ন কথা। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বলেন, আমি এ বিষয় কিছুই জানি না, আমি কোনো সন্তান নেইনি, যারা নিয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
কথোপকথনের এক পর্যায়ে তার নাম শামিম আহমেদ, পেশায় শিক্ষক বলে জানান। তিনি বলেন, তার কোনো সন্তান নেই। একটি সন্তানের খোঁজে আছেন অনেক দিন। তাই তার এক ছাত্র একটি সন্তানের খোঁজ দেন। পরে ওই ছাত্র তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। তার মা ও তার ভাই দেবিদ্বার উপজেলার চরবাকর গ্রামের নুরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
শামিম আহমেদ বলেন, নুরুল ইসলাম ওই শিশুটির সন্ধান দেন এবং বাচ্চা নিতে হলে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে বলে জানান। এত টাকা দিয়ে বাচ্চা কেনার সামর্থ্য আমার ছিল না। পরে আরো একটি ধনাঢ্য নিঃসন্তান পরিবারের বাচ্চার প্রয়োজন হলে, ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
তিনি বলেন, ওরা গত ১৬ মার্চ এসে বাচ্চা দেখে পছন্দ করেন এবং কথাবার্তা শেষে গত ২৯ মার্চ ৩শ’ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে কিছু শর্ত সাপেক্ষে (শর্তগুলোর মধ্যে এ বাচ্চা আর কখনো দাবি করতে পারবে না, তার খোঁজখবরও নিতে পারবে না উল্লেখযোগ্য) ৩ জন সাক্ষীর স্বাক্ষর নিয়ে ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা পরিশোধ করে বাচ্চা নিয়ে যায়।
তবে শামিম আহমেদ ওই পরিবারের পরিচয় দিতে অপারগতা জানান, এক পর্যায়ে বাচ্চা গ্রহীতার নাম মঞ্জু, চট্টগ্রামে অডিটর হিসেবে কর্মরত আছেন বলে জানান।
তিনি আরও জানান, বাচ্চাটি ভালো থাকবে, ওই পরিবার বিশাল সম্পদের মালিক। ভবিষ্যতে সব কিছুরই মালিক হবে ওই শিশুটি।
নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক ওই বাড়ির কয়েকজন নারী জানান, বাচ্চা বিক্রি করে দেয়ার সংবাদ পেয়ে আমরা বাচ্চাটিকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি, পারিনি। সেলিম মিয়া আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে এবং তার স্ত্রীকে মারধর করে বাচ্চাটিকে নিয়ে যায়। ওই সময় বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষও ছিল না, যে তাকে বাধা দিবে।
তারা জানান, ২২ বছর পূর্বে বিলকিস বেগমের সঙ্গে সেলিমের বিয়ে হয়। তাদের ৫ ছেলে ও ১ কন্যা সন্তান হয়। বড় ছেলে মো. সবুজ (২০) গ্রামের বাড়িতে থেকে সিএনজি চালায়, আকাশ (১৭) চট্টগ্রামে দাদা-দাদি-চাচার সঙ্গে থেকে সিএনজি চালায়, সাওন (১৪) স্থানীয় একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে আছে, চতুর্থ ছেলে সাওন (৯) এবং এক মাত্র মেয়ে সাথী (১২) স্থানীয় বারুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। আর সর্বশেষ পঞ্চম পুত্র ইয়াছিনকে বিক্রি করে দেয়া হয়।
নাম না প্রকাশের শর্তে এলাকার কয়েকজন লোক জানান, বারুর এবং পোনরা গ্রামে বড় বড় জুয়ার আসর বসে। সেলিমও পাক্কা জুয়ারি আয়ের অধিকাংশ টাকাই জুয়া খেলে শেষ করে। জুয়ায় অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে সে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল কালাম আজাদ জানান, বিষয়টি আমি শুনেছি, এটি অতন্ত দুঃখজনক ঘটনা। আমি সবার সঙ্গে কথা বলে বাচ্চাটিকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবো।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবীন্দ্র চাকমা জানান, এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তবে যেহেতু বিষয়টি এখন শুনেছি, তদন্তপূর্বক বাচ্চা উদ্ধারসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।